বিপাকে সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষক।

Image

ডেস্ক,৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৩:

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি অনার্স ও মাস্টার্স কলেজগুলোতে যোগদান করে বিপাকে পড়েছেন সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষক। চাকরিতে যোগদানের পর থেকে প্রায় বিনা বেতনে পাঠদান করতে হচ্ছে তাদের। বেতনভাতার দাবিতে বারবার আন্দোলন করেও আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি। তাই হতাশ হয়ে ফের আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই শিক্ষকেরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশব্যাপী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে ১৯৯৩ সালে বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করার অনুমতি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অভ্যন্তরীণ আয় থেকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদান করবে এমন শর্তে গত ৩০ বছরে প্রায় ৬০০ কলেজকে দেওয়া হয়েছে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের অনুমোদন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষক (অনার্সের জন্য পাঁচজন এবং মাস্টার্সের জন্য আরো পাঁচজন) নিয়োগ হয়েছে এ ধরনের ডকুমেন্ট এবং অন্যান্য বিষয় যাচাই-বাছাই করে কলেজে অনার্স বা মাস্টার্স চালুর অনুমতি দিলেও শিক্ষকরা কী হারে বেতন পান বা আদৌ বেতন পান কি না তা যাচাই করে না।

আরও পড়ুন : কারিগরি শিক্ষকদের জানুয়ারির এমপিওর চেক ছাড়

প্রভাষক হিসেবে জাতীয় বেতন স্কেলের নবম গ্রেডে যোগদান করেন। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ কলেজ অনার্স ও মাস্টার্স প্রগ্রামে কর্মরত শিক্ষকদের উক্ত স্কেলে বেতন প্রদান না করে তার চেয়ে অনেক কম হারে বেতন প্রদান করে থাকে এবং ক্ষেত্র বিশেষে অনেক কলেজ তাও দেয় না।

বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকরা জানান, বেসরকারি কলেজগুলোতে যোগদান করে তারা প্রতারিত হয়েছেন। অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা জনবল কাঠামো বা সরকারি নীতিমালাতে অন্তর্ভুক্ত নয় এই অজুহাতে তাদেরকে তিনদশক ধরে বেতনবঞ্চিত রাখা হয়েছে।

তাদের দাবি, ১৯৯৫, ২০১০, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২১ সালে জনবল কাঠামো সংশোধন করা হলেও বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করা হয়েছে। তারা জানান, শিক্ষকদের বেতনের নাম করে ছাত্রছাত্রীদের থেকে মাসে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে বেতন নেওয়া হলেও শিক্ষকদের বেতন বাবদ ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার দিয়ে থাকে কলেজগুলো। অনেক কলেজ তাও দেয় না।

আরো পড়ুন: প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা পাচ্ছেন

বেসরকারি কলেজ (অনার্স-মাস্টার্স ) শিক্ষক সমিতির সভাপতি হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা কলেজগুলোতে যোগ দিয়ে বিপদে পড়েছি। আমরা জানতাম না যে, কলেজগুলো নিজেদের অর্থায়নে শিক্ষকদের বেতন দেবে। আমরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রভাষক পদ ও নবম গ্রেড দেখে আবেদন করেছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শর্ত পূরণ করে নিয়োগ পেয়েছি। এরপরও আমরা বেতনবঞ্চিত।

হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা বারবার বেতনভাতার জন্য দাবি জানিয়েছি। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এখন শিক্ষকরা কলেজের কাছে বেতন চাইলে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। অনেককে সাময়িক বরখাস্ত বা স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন :প্রাথমিকে সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি

তিনি আরও বলেন, সদ্য জাতীয়করণকৃত কলেজের অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকরা যদি ক্যাডার /নন ক্যাডার হতে পারে তবে বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকরাও এমপিও পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। কারণ তারা যেভাবে নিয়োগ পেয়েছে আমরাও সেভাবেই নিয়োগ পেয়েছি। কিন্তু শিক্ষার নামে বাণিজ্য করা একটি শ্রেণির অশুভ প্রভাবের কারণে আমরা বেতনভাতা বঞ্চিত হচ্ছি।

তবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমপিও কিংবা জাতীয়করণ ছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের বেতন ও ভাতা পরিশোধ করতে পারে।

ব্যানবেইজের তথ্যমতে, বেসরকারি কলেজের অনার্স ও মাস্টার্স প্রগ্রামে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৪৩১৩৮ জন (৮৮৮৭৮০+৩৫৪৩৫৮)। কলেজভেদে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। গড়ে ৬০০ টাকা করে ১২ লাখ শিক্ষার্থীর এক বছরের বেতন আসে ৮৬৪ কোটি টাকা। ৫৫০০ জন শিক্ষকের মধ্য থেকে দেড় হাজার জনকে সহকারী অধ্যাপকের স্কেল এবং অবশিষ্ট চার হাজার জনকে যদি প্রভাষকের স্কেলে বেতন হিসাব করা হয়, তাহলে ৫৫০০ শিক্ষকের এক মাসের বেতন হবে ১৪ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার।

এই হিসাবে এক বছরের মূল বেতন এবং দুই ঈদে দুটি বোনাস এবং বৈশাখী ভাতার জন্য প্রয়োজন হবে ২০১ কোটি টাকা। প্রতিবছর ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের জন্য প্রয়োজন হবে ৮৫-৯০ লাখ টাকা। এখানে ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী যদি সিনিয়র শিক্ষকদের আরো পাঁচটি ইক্রিমেন্টসহ বেতন হিসাব করা হয়, তাহলে ২০১ কোটি টাকার স্থলে ২০৫-২১০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে, যা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগৃহীত বেতনের ২৫ শতাংশের বেশি নয়।

‘‘কলেজগুলো প্রতিমাসে শিক্ষার্থীদের থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে। সেই অর্থে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই অর্থ বিভিন্ন উপায়ে তছরুপ করছে। ফলে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে- অভিযোগ শিক্ষকদের”

আর যদি সব শিক্ষককে নবম গ্রেডভুক্ত হিসাবে বেতন প্রদান করা হয়, তাহলে বছরে প্রয়োজন হবে মাত্র ১৭২ কোটি টাকা। সুতরাং প্রত্যেক শিক্ষককে মাসিক এক হাজার ৫০০ টাকা হারে চিকিৎসা ভাতা, বিধি মোতাবেক বাড়িভাড়া ভাতা, অবসরকালীন গ্র্যাচুইটি, কল্যাণ তহবিল, ভবিষ্য তহবিলের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে এবং এটি করার জন্য প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত নীতিমালা এবং সংশ্লিষ্ট মহলের আন্তরিক প্রচেষ্টা।

তারা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ‘একটি বিশেষ রাজস্ব তহবিল গঠন করে’ সরকারের অতিরিক্ত কোনো অর্থ ব্যয় ছাড়া বেসরকারি কলেজের অনার্স ও মাস্টার্স প্রগ্রামের শিক্ষকদের বেতন প্রদান করা যেতে পারে।

শিক্ষকদের অভিযোগ, কলেজগুলো প্রতিমাসে শিক্ষার্থীদের থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে। সেই অর্থে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই অর্থ বিভিন্ন উপায়ে তছরুপ করছে। ফলে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই শিক্ষকদের বেতন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ নয়। বেসরকারি কলেজগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ আয় থেকে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করবে এমন লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদেরকে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে কলেজগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রাখেনি। এর ফলে বিভিন্ন সময় বেতনবঞ্চিত শিক্ষকরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ করেন। আমরা তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজগুলোর অনুমোদন বাতিল করতে গেলে তারাই আবার এর বিপক্ষে অবস্থান নেন।

তিনি আরও বলেন, আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভায় এই শিক্ষকদের বেতন প্রদানের কথা বলেছি। বিভিন্ন সময় শিক্ষামন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের এ বিষয়ে বলেছি। এর বেশি আর কি করতে পারি? এরপরও শিক্ষকরা মাঝেমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করে আন্দোলন শুরু করে। এটা অন্যায়।

১২ মার্চ থেকে অবস্থান কর্মসূচি
এদিকে বেতনবঞ্চিত কলেজ শিক্ষকরা ফের আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগামী ১২ মার্চ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অবস্থান নিয়ে অনশন কর্মসূচি শুরু করবেন তারা।

সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) এ তথ্য জানিয়ে বেসরকারি কলেজ (অনার্স-মাস্টার্স ) শিক্ষক সমিতির সভাপতি হারুন অর রশীদ বলেন, আমাদের পীঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন আন্দোলন ছাড়া উপায় দেখছি না। তিনি বলেন, গত ৫ (ফেব্রুয়ারি) আমরা একটি জুম মিটিং করেছি। সেখানে ১২ মার্চ থেকে আন্দোলন শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।