বঞ্চনা ও অবহেলার অভিযোগ প্রাথমিক শিক্ষকদের

Image

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদমর্যাদা সরকারের ‘তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী’র। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা জাতীয় বেতন স্কেলের ১৫তম গ্রেড থেকে ১৩তম গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত হন (১১ হাজার টাকা স্কেল)। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম ও ১২তম গ্রেডে। এই শিক্ষকদের অভিযোগ, তাঁদের পদমর্যাদা ও বেতন দুটিই কম এবং তাঁরা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার।

আরো পড়ুন: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল মঞ্জুর

একসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নারীরা এসএসসি পাস শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিয়োগ পেতেন। ২০১৯ সালের নিয়োগবিধি অনুসারে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক নির্ধারণ করা হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা উন্নীত করার পর থেকে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা তাঁদের বেতন স্কেল দশম গ্রেডে উন্নীত করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের বক্তব্য, একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অনেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ব্লক সুপারভাইজার, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) পদে দশম গ্রেডে চাকরি করছেন। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা বেতন গ্রেডে পিছিয়ে।
কত বেতন পান প্রাথমিকের শিক্ষকরা

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা শুরুতেই বেতন পান ১৩তম গ্রেডে (১১,০০০-২৬,৫৯০ টাকা)। এর মধ্যে মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। তবে এলাকাভেদে বাড়ি ভাড়ায় ভিন্নতা রয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের ৬০ শতাংশ। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং সাভার পৌর এলাকার জন্য বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া, অন্য এলাকার জন্য এটি মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ নির্ধারিত।

সহকারী শিক্ষকরা চিকিৎসা ভাতা বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা, টিফিন ভাতা ২০০ ও যাতায়াত ভাতা ৩০০ টাকা পান। সব মিলিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট বেতন দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং সাভার পৌর এলাকায় মোট বেতন ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরে দেশের অন্য এলাকায় সহকারী শিক্ষকদের মোট বেতন ১৭ হাজার ৯৫০ টাকা। এই বেতন থেকে কল্যাণ তহবিলের জন্য ১৫০ টাকা ও ডাকটিকিটের জন্য ১০ টাকা কেটে রাখা হয়।
সহকারী শিক্ষকরা বলছেন, প্রতিবছর তাঁদের মূল বেতন ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৫৫০ টাকা বাড়ে। এ ছাড়া, তাঁরা বছরে মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থাৎ ১১ হাজার টাকার দুটি উৎসব ভাতা পান। মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে, অর্থাৎ ২ হাজার ২০০ টাকা পান বৈশাখী ভাতা। চাকরি তিন বছর হলে মূল বেতনের সমপরিমাণ শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাওয়া যায়। আর চাকরিজীবনে প্রাথমিকের একজন সহকারী শিক্ষক পান দুটি টাইম স্কেল।

পদোন্নতি পেয়ে তাঁদের সহকারী প্রধান শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে পদোন্নতির সযোগ খুবই কম বলে তাঁরা জানান। উপজেলায় পদ খালি থাকা সাপেক্ষে পদোন্নতি পাওয়া যায়। অনেকে ২০-২২ বছর চাকরি করেও পদোন্নতি পান না।
রাজধানীর সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং ‘বাংলাদেশ সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের’ সভাপতি মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। অথচ আমাদের বেতন ও পদমর্যাদা খুবই লজ্জাজনক। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকের বেতন সরকারি নার্সদের চেয়ে কম, অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁদের চেয়ে বেশি।’ ‘এটি এক ধরনের বঞ্চনা’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সারাদেশে ৬৫ হাজার ৬২০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সোয়া ৪ লাখ সহকারী শিক্ষক ও ৬৫ হাজার ৬২০ প্রধান শিক্ষক পদ রয়েছে। তবে প্রধান শিক্ষক পদে ২৯ হাজার জন ও সহকারী শিক্ষক পদে ৩ লাখ ৯২ হাজার জন কর্মরত আছেন। বাকি পদগুলো শূন্য রয়েছে।

প্রধান শিক্ষকদের অবস্থাও একই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের ভাগ্যের বদল হয়নি। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে গেজেট হয়নি। শিক্ষকদের অভিযোগ, মন্ত্রণালয়ের গড়িমসিতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন আটকে আছে এবং তাঁদের বেতন রয়ে গেছে আগের কাঠামোয়। আগের মতোই তাঁরা ‘তৃতীয় শ্রেণির’ পদমর্যাদার বেতন পাচ্ছেন। এই ‘বঞ্চনা লাঘবে’ তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সভাপতি রঞ্জিত কুমার ভট্টাচার্য  বলেন, ‘২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদানের ঘোষণা দেন এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল এক ধাপ উন্নীত করা হয়। কিন্তু দুটি পদক্ষেপের একটিও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই আমরা হতাশ।’
একই রকম কথা বলেন বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি রিয়াজ পারভেজ। তিনি বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির নন-গেজেটেড পদমর্যাদা দিয়ে সরকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ১১তম ও ১২তম গ্রেডে রেখেছে। অথচ দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা পাওয়া পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, নার্স, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন সচিবদেরও দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সম্পাদক স্বরুপ দাস  বলেন, ‘প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা অনেক অবহেলিত। সরকারের সব বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার কর্মকর্তারা দশম গ্রেডে বেতন পেলেও সরকারি প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে।’ তিনি বলেন, ‘তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু ৯ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণির আর্থিক সুবিধা মিলছে না।’
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে কিছু দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো– চাকরি ১০ বছর ও ১৬ বছর হলে উচ্চতর গ্রেড প্রদান, নবম পে কমিশন গঠনসহ ২০তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ এবং টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল।

প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি করতে চান না অনেকে
বেতন ও পদমর্যাদা কম হওয়ায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের চাকরি করতে চান না অনেকে। ইতোমধ্যে ৩৪তম বিসিএস থেকে ৮৯৮ জন ও ৩৬তম বিসিএস থেকে অনেক প্রার্থীকে প্রধান শিক্ষক পদে সুপারিশ করা হলেও অনেকে ওই চাকরিতে যোগদান করেননি। আর যাঁরা করেছেন তাঁদের অনেকে দশম গ্রেডে অন্য চাকরি নিয়ে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, দ্বিতীয় শ্রেণির অন্য চাকরিজীবীরা দশম গ্রেডে বেতন পেলেও তাঁরা তা পান না। এ কারণেই তরুণরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আগ্রহী হচ্ছেন না।

আদালতে রিট
পদমর্যাদা বাড়াতে প্রধান শিক্ষকরা উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। এরপর ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন দশম গ্রেডে প্রদান ও গেজেটেড পদমর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীন উভয় ধরনের প্রধান শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ওই নির্দেশনা ২০১৪ সালের ৯ মার্চ থেকে কার্যকর করার আদেশ দেন আদালত। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেন। কিন্তু পরে সরকার পক্ষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। বিষয়টির এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।

কী বলছে মন্ত্রণালয়
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিবের রুটিন দায়িত্বে থাকা মো. মোশাররফ হোসেন  বলেন, ‘শিক্ষকরা আমাদের সমাজে সম্মানের পাত্র। বেতন গ্রেড দিয়ে তাঁদের মর্যাদা নির্ধারিত হয় না। সামাজিকভাবে তাঁরা অত্যন্ত সম্মানিত। আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যেই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। আরও দিতে পারলে ভালো হতো নিশ্চয়ই। তবে এটা শুধু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একার ওপর নির্ভর করে না। এর সঙ্গে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। একসঙ্গে ৪ লাখ শিক্ষকের বেতন বাড়াতে গেলে সরকারেরর বিপুল অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের চেষ্টা ও পরিকল্পনায় আছে। তবে উচ্চ আদালতে এ নিয়ে মামলা চলমান। মামলা নিষ্পত্তি হলে আদালতের নির্দেশ অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুত্র: দৈনিক সমকাল

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।