প্রাথমিকে ল্যাপটপ ক্রয়ে অনিয়মের অবিযোগ

প্রলয় শীলঃ

নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে ল্যাপটপ কিনে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের আয়োজন চূড়ান্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।এতে সরকারের লোকসান হবে প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের অর্থথায়নে প্রাইমারি স্কুলে বিতরণের জন্য এই ৫০ হাজার ল্যাপটপ কেনা হচ্ছে।

লুটপাটের আয়োজনের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে তারা কৌশলে কেনাকাটার নথি থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলে সর্বনিম্ন দরদাতা দুটি কোম্পানিকে বাদ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। টেকনিক্যাল ইভালুয়েশনেরও বাইরে রেখেছেন কোম্পানি দুটিকে। কঠিন শর্ত জুড়ে দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে বিরত করেছেন দেশীয় ব্র্যান্ড ‘দোয়েল’ ল্যাপটপের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে (টেশিস)। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত ও ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপিত ও অনুমোদনপ্রাপ্ত ল্যাপটপগুলো কেনা হলে সরকারের লোকসান হবে কমপক্ষে ১৪৩ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এসব ল্যাপটপ কেনার ক্ষেত্রে এই দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়েও অবহিত করা হয়েছে।

জানা যায়, গত ২৮ মে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ‘তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’র (পিইডিপি-৩) অধীনে সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জন্য ৫০ হাজার ল্যাপটপ কেনার জন্য গত ২৮ মে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের সিডিউল জমা দেওয়ার সর্বশেষ তারিখ ছিল গত ২৯ জুন। এ দরপত্রে আটটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। পাঁচটি লটে আহ্বান করা এসব দরপত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন লটে হায়ার ইন্টারন্যাশনাল ৩০৮ ডলার, হায়ার ইলেকট্রনিক্স অ্যাপ্লায়েন্স ৪১৬ ডলার, গ্গ্নোবাল ব্র্যান্ড ৬৬৫ ডলার, স্মার্ট টেকনোলজি ৬৭৬ ডলার, কম্পিউটার সোর্স ৬৭২ ডলার, ফ্লোরা লিমিটেড ৬৮০ ডলার, ফ্লোরা টেলিকম ৬৭৮ ডলার ও থাকরাল ইনফরমেশন সিস্টেম ৬৭০ ডলার দর দিয়েছে।

ছেঁড়া হয়েছে নথির কাগজ :অতিরিক্ত দামে ল্যাপটপ কেনার লক্ষ্যে মূল্য তালিকায় থাকা সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান দুটিকে কৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে। দরপত্রে অংশ নেওয়া দুটি কোম্পানি গণশিক্ষামন্ত্রীর কাছে লিখিত এক অভিযোগে জানিয়েছে, দরপত্রে চাওয়া সব কাগজপত্রই তারা জমা দিয়েছেন। কিন্তু নথি থেকে তাদের কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশেষ আঁতাতের মাধ্যমে বেশি দামে ল্যাপটপ কিনতেই এ কাজ করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর মাধ্যমে তাদের পকেটে আসবে কমিশনের কোটি কোটি টাকা।

টেকনিক্যাল ইভালুয়েশনেও বাদ সর্বনিম্ন দরদাতারা :দরপত্রের মূল্য তালিকার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় বাকি ছয়টি কোম্পানি থেকে ল্যাপটপগুলো কিনলে বাংলাদেশ সরকারের নূ্যনতম ১৪৩ কোটি টাকা লোকসান হবে এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চালিত এ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের ঋণের বোঝাও বাড়বে। কারণ বাদপড়া দুটি প্রতিষ্ঠানের মূল্য গড়ে ৩১০ ও ৪১৬ মার্কিন ডলারের মধ্যে। কিন্তু বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মূল্য ৬৬০-৬৮০ মার্কিন ডলারের মধ্যে রয়েছে। এদের সবার নির্ধারিত মূল্য খুবই কাছাকাছি_ যা নিজেদের মধ্যে

আঁতাতের ফল বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এমনকি ওই ছয়টি প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো লটে সর্বনিম্ন হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক আঁতাতের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় যখন দেখা যায়_ সর্বনিম্ন দুটি প্রতিষ্ঠানকে টেকনিক্যাল ইভালুয়েশনে বাদ দেওয়া হয়। সম্মিলিতভাবে এই টেন্ডারে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও তাদের নিযুক্ত কনসালট্যান্টদের জড়িত থাকারও স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ছয়টি কোম্পানির মূল্য তালিকা মন্ত্রিসভার ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটিতে উপস্থাপন করেছে এবং তা এই কমিটির অনুমোদন পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সিন্ডিকেট চক্রের এমন তৎপরতা নজিরবিহীন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি সুস্পষ্ট যে, ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মূল্য খুবই কাছাকাছি এবং প্রত্যেকে কোনো না কোনো ভাগে (লটে) কাজ পেয়েছেন। সিন্ডিকেট মহলের চাপে ইভালুয়েশন কমিটি এ ব্যাপারটি আমলে না নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।’

তবে ল্যাপটপ ক্রয় কার্যক্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) গিয়াস উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, ‘নানা কারণে এই ৫০ হাজার ল্যাপটপ কিনতে দেরি হয়েছে। এটি যাতে বাস্তবায়ন না করা যায়, সে জন্য নানা ঝামেলা করা হচ্ছে। এর আগে বিশ্বব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অফিসে অভিযোগ জানিয়ে গত ৬ অক্টোবর টেন্ডার স্থগিত করা হয়। পরে ২২ নভেম্বর বিশ্বব্যাংক অনাপত্তিপত্র দেয়। এরপর সভা করে টেন্ডার আহ্বান করা হয়।’ তিনি জানান, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের বিষয় তার জানা নেই।

বাজারদরের চেয়ে মূল্য প্রায় দ্বিগুণ :এদিকে খুচরা বাজারে ল্যাপটপের মূল্য যাচাই করে দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত একই কনফিগারেশনের ল্যাপটপ বাজারে দুই বছরের ওয়ারেন্টিসহ ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর চাইছে তিন বছরের ওয়ারেন্টির ল্যাপটপ। কম্পিউটার বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সে ক্ষেত্রে ল্যাপটপের মূল্য শতকরা ১ বা ২ ভাগের বেশি হওয়ার কথা নয়। আমদানি কর, অতিরিক্ত ওয়ারেন্টির মূল্য ও পাইকারি মূল্য বিবেচনায় নিলে বাজারে সরবরাহরত ল্যাপটপের মূল্য ৩৫০ মার্কিন ডলারের বেশি হবে না বলে ল্যাপটপ ব্যবসায়ীরা জানান।

ইন্টারনেট পণ্য বিক্রেতা ‘আমাজন’ থেকে মূল্য যাচাই করলে দেখা যায়, এই স্পেসিফিকেশনের ল্যাপটপ ৩০০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলারের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট, যেসব প্রতিষ্ঠান ৬৬০ থেকে ৬৮০ মার্কিন ডলার দর দিয়েছে, সেগুলোর আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের তুলনায়ও বেশি দাম ধরা হয়েছে।

অংশ নিতে পারেনি টেশিস :অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দরপত্রে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকেও কৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে। দেশীয় ব্র্যান্ড ‘দোয়েল’ ল্যাপটপের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) এ দরপত্রে অংশ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু দরপত্রের মধ্যে এমন সব নিয়ম ও শর্তাবলি জুড়ে দেওয়া হয়, যাতে ‘টেশিস’ এখানে কিছুতেই অংশ নিতে না পারে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর ভাষ্য :প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নানা জটিলতায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দেরি হয়েছে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। সম্প্রতি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রকল্পের অর্থ অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হয়েছে। এমনিতেই বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের নানা শর্ত থাকে। সেইসব শর্তকে ব্যবহার করে ও বেনামে অভিযোগ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।’

মন্ত্রণালয়ে টেন্ডারে অংশ নিতে না পারা প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “বিশ্বব্যাংক বিষয়টির সম্পূর্ণ দেখভাল করছে। মন্ত্রণালয়ের কিছুই করার নেই। তাছাড়া বিশেষজ্ঞরা টেন্ডার কমিটিতে রয়েছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই ‘হয়তো’ টেন্ডার হয়েছে। কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে এমন অভিযোগ করতে পারেন।” তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে এর কেনাকাটা-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (অর্থ) অতিরিক্ত সচিব এনামুল হক জানান, ল্যাপটপ ক্রয়-সংক্রান্ত টেন্ডারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।