সুইপার কলোনীর প্রথম গ্রাজুয়েট হলেন সনু রাণী




ডেস্ক,১ মে: নারায়ণগঞ্জের টানবাজার সুইপার কলোনির প্রথম স্নাতক (গ্র্যাজুয়েট) ডিগ্রি অর্জন করলেন সনু রাণী। ১৫০টি পরিবারের এই কলোনিতে ১৯৬৪ সাল থেকেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তবু ২০০৬ সালের আগে সেই কলোনির কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করতে পারেননি। সনুর মতে, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, পরিবারগুলোর অসচেতনতা ও অর্থনৈতিক দৈন্যই এর জন্য দায়ী। সুইপারদের মাতৃভাষা হিন্দি হলেও পাঠ্যবইগুলো বাংলায়। বাংলা বুঝতে না পারায় প্রাথমিক পর্যায়েই ছেলেমেয়েরা ঝরে পড়ে। স্কুলের শিক্ষকেরা ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন সংস্কৃতির হওয়ার কারণে পড়াশোনাটা শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে না।

সনু বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিকের (এইচএসসি) পাঠ চোকানোর পরই আমি ও মিনা (সনুর বান্ধবী) ভাবলাম, শিক্ষক হতে হবে।’

শিশুদের বাংলা শেখানোর জন্যই শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা। শিক্ষক না হতে পারলে কী করবেন? প্রশ্ন করতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলেন সনু। বলেন, ‘অন্য কিছু করার হলে তো এত দিনে সেটাই করতাম। এনজিও থেকে চাকরির প্রস্তাব আসে। মোটা অঙ্কের বেতনের কথা বলে। কিন্তু তারা কী দিচ্ছে, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আমি কী করতে চাই, সেটাই জরুরি। আমি আমার কলোনির শিশুদের নিয়েই কাজ করতে চাই। নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি এটা আমাদের দায়বদ্ধতা।’ বলতে বলতেই চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে সনুর। পাশে বসা নিজের পাঁচ বছরের ছেলে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরেন।

মেথরপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে সনু ও মিনা ভর্তি হন র‌্যালি বাগান গণবিদ্যা নিকেতন উচ্চবিদ্যালয়ে। নারায়ণগঞ্জ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে স্নাতক (বিবিএস) করেন দুজন। কলোনিতেই বিয়ে করেছেন তারা। স্বামী ও সন্তান নিয়ে কলোনির বাইরে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন মিনা রানী। সেখানে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গৃহিণী পরিচয় দেওয়াটা নিজের জন্য জুতসই মনে হয় না। আমরা যখন পড়াশোনা করতে বাইরের স্কুলে গেলাম, তখন অনেকেই ভর্ৎসনা করল। মা বাবাকে এসে বলল, মেয়েমানুষ এত পড়াশোনা করে কী হবে? শেষ পর্যন্ত তো চুলাই সামলাতে হবে। যদি নিজের স্বপ্নটা পূরণ না হয়, তবে তাদের কথাটাই সত্য হয়ে যাবে। আমরা আমাদের স্বপ্ন ছুঁতে না পারলে মেয়েদের জন্য বাজে উদাহরণ হয়ে যাবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা (কলোনির মেয়েরা) পড়তে চাইলে তাদের স্বজনেরা আমাদের দেখিয়ে বলবে, এত পড়ে কী হলো, সেই তো চুলাই সামলাচ্ছে।’

সনুর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোথাও নামমাত্র পয়সায় আবার কোথাও বিনা পয়সায় কলোনির শিশুদের পড়ান তিনি। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন করেছেন সনু, মিনা দুজনেই। এখন পরীক্ষার অপেক্ষায় আছেন। মেথরপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অর্চনা রানী সাহা মনে করেন, সুইপার কলোনির স্কুলগুলোতে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্য থেকে উঠে আসা লোকজনকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘শুধু ভাষা না বোঝার কারণেই কলোনির ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ে। কলোনির বাসিন্দাদের মধ্য থেকে শিক্ষক হলে ভাষার প্রতিবন্ধকতা যেমন দূর হবে, তেমনি শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বোঝাপড়া নিবিড় হবে।

নারায়ণগঞ্জের জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মজিব আলম বলেন, ‘কলোনির বাচ্চাদের মাতৃভাষা হিন্দি, পড়াশোনা বাংলায়। ফলে সামান্য প্রতিবন্ধকতা আছে। কলোনি থেকে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে আমাদের তেমন ভাবনা নেই। এটা জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়।’

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।