মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বিষয় একসঙ্গে পাঠ্যবইয়ে নয়

শিশুরা ছাপার অক্ষরে যা দেখে সেটাই বিশ্বাস করে। তাই তাদের পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকা অমার্জনীয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তাদের সরিয়ে যোগ্য ও দক্ষ লোকদের সেখানে দায়িত্ব দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম অবশ্যই হতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার। নিরপেক্ষতার নামে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিষয় একই সঙ্গে পাঠ্যবইয়ে রাখা চলবে না। এ কাজে রাজনৈতিক দল বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।

গতকাল শনিবার সকালে সমকাল-গণসাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত ‘প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়ন :নাগরিক সমাজের ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও গণসাক্ষরতা অভিযানের কর্মকর্তারা এতে বক্তব্য রাখেন। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল আলোচনার সঞ্চালনা করেন সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি।

ads

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় সমকাল কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় বক্তারা বলেন, গত দশ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বেশি ভুল ধরা পড়েছে শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেশমাত্র বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বইয়ে কেন এনসিটিবির হিন্দু চেয়ারম্যানের নাম ছাপানো যাবে না? সরকার হেফাজতের ১৭ দফা দাবিই

পূরণ করেছে পাঠ্যপুস্তকে। হুমায়ুন আজাদ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেখকদের লেখাও বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বইয়ের পাতায় পাতায় ভুল। শব্দ, বাক্যবিন্যাস, পরিমিতি বোধের অভাব সবকিছুতেই ভুল। চিত্র উপস্থাপনেও অজ্ঞতার অভাব ছিল। বক্তারা বলেন, বই চূড়ান্তস্ন করে চূড়ান্ত প্রুফ দেখার কাজটি এনসিটিবির কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা করেন না। এমনকি বইয়ের লেখক ও সম্পাদকদেরও তা দেখানো হয় না। যদি এসব হয়েও থাকে, তবু বইয়ে নাম ছাপা হলে সংশ্লিষ্ট লেখক ও সম্পাদকদের তার নৈতিক দায় নিতে হবে।

আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক শফি আহমেদ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ মমতাজ লতিফ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. মনজুর আহমেদ, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ ও আইইআরের অধ্যাপক মরিয়াম বেগম, শিক্ষাবার্তার সম্পাদক এ এন রাশেদা, সমকালের সহযোগী সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত, গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাস ও কেএম এনামুল হক, সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি সাবি্বর নেওয়াজ, কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম, দনিয়া একে হাইস্কুলের একজন অভিভাবক রোমানা ইয়াসমিন ও অভিভাবক কেশব সরকার।

আলোচনার সূত্রপাত করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমের উন্নয়নের বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযান সব সময়ই সরকারের সহায়তার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে। বাংলা একাডেমির বানান-রীতি এবারের পাঠপুস্তক প্রণয়নে ঠিকমতো ব্যবহৃত হয়নি। সে সঙ্গে উপস্থাপনটিও সঠিক ছিল না। এবারের বইয়ের বিষয়বস্তুতে এমন কিছু আছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়ে এনসিটিবিকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি করে প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম, যা মানা হয়নি। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুতে শিক্ষার্থীর বয়স, মেধা-মনন, স্বাধীন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা তুলে ধরাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা সব সময়ই দেখেছি, প্রাথমিক শিক্ষাকে সঠিকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাই শিশুদের মেধাবিকাশের ভিত্তি। পাঠ্যপুস্তকের ভুলের বিষয়ে দায় এড়ানো থেকে এবার সরকার সরে এসেছে, এটাকে সাধুবাদ জানাই। আশা করি, ভুলগুলো সংশোধনের জন্য সরকার যেসব কমিটি গঠন করেছে, তারা সঠিকভাবে ভুলের বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। সে সঙ্গে তাদের পরামর্শও সরকার গ্রহণ করবে বলে আশা করি।

অধ্যাপক শফি আহমেদ বলেন, এবারের পাঠ্যবইয়ে শুধু অবহেলা নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবহেলা আছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠী ১৭ দফা দাবি সরকারের কাছে করেছিল যাদের ১৭টি দাবিই পূরণ করা হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। শিক্ষানীতি পাস হয়েছে ২০১০ সালে। সাত বছরেও প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম থেকে অষ্টমে উন্নীত করা যায়নি। শিক্ষা আইন করা হচ্ছে, যাতে ছায়াশিক্ষা (কোচিং সেন্টার) নামক ভয়ঙ্কর একটি বিষয় রাখা হয়েছে। এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অসততা রয়েছে। তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেশমাত্র বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বইয়ে কেন এনসিটিবির হিন্দু চেয়ারম্যানের নাম ছাপানো যাবে না?

ড. মনজুর আহমেদ বলেন, পাঠ্যপুস্তকে এ ধরনের ভুল নতুন কিছু নয়। তবে এবারের পাঠ্যপুস্তকে ভুলের পরিমাণ ও গুণাগুণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রতি বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যপুস্তক দেওয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে এনসিটিবি যেন মনে করছে, তারা ভুল করার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজটি ক্রমাগতভাবে সারা বছর ধরে করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশে কোনো বিশেষজ্ঞ আছে বলে আমার জানা নেই। এনসিটিবিতে একটি গ্রুপ ঘাপটি মেরে আছে। যাদের কারণে প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তকে ভুল ধরা পড়ছে।

মমতাজ লতিফ বলেন, নিরপেক্ষতার নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর বিপক্ষের বিষয় একসঙ্গে পাঠ্যবইয়ে দেওয়া যাবে না। একটি বিশেষ গোষ্ঠী যে তালিকা দিচ্ছে তাই বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, পাঠ্যবই অসাম্প্রদায়িক করতে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়া হবে। কারণ সংবিধান আমাদের পক্ষে রয়েছে।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা না করে শিক্ষাবিষয়ক একটি মাত্র মন্ত্রণালয় করা দরকার। কয়েক দশক ধরে আমরা বলে আসছি শিক্ষকদের বাদ দিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। অথচ এবারের পাঠ্যবইয়ে যারা ভুল করেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা সবাই শিক্ষক। বইয়ে আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছে। যে নীতি প্রতিষ্ঠা করতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার বিপরীত কেন আদর্শ পাঠ্যবইয়ে থাকতে পারে না।

অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বলেন, আমার নাতি-নাতনিরা এনসিটিবির পাঠ্যবই পড়ে। সেখানে ভুল দেখলে আমি নিজে তা ঠিক করে পড়াই। অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, চলিত আর শুদ্ধ, ছবিতে, প্রচ্ছদে, জেন্ডারে, শব্দ ও তথ্যে পর্যন্ত ভুল এবারের পাঠ্যবইয়ে। একইভাবে সূচিপত্রে, যতিচিহ্নের প্রয়োগেও ভুল। আর রয়েছে পক্ষপাতিত্বের ভুল। রয়েছে মূল্যবোধের ভুল।

অধ্যাপক মরিয়াম বেগম বলেন, পাঠ্যবই পুরোপুরি শহরকেন্দ্রিক করে রচনা করা হয়েছে। গ্রামীণ শিশুদের কথা ভাবা হয়নি। সকালের নাশতার উদাহরণ দিতে গিয়ে স্যান্ডউইচ, চেরি ফল আর পুডিংয়ের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে কতজন শিশু সকালে স্যান্ডউইচ দিয়ে নাশতা করে?

মুস্তাফিজ শফি বলেন, পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনার সঙ্গে যারা যুক্ত, যাদের নাম ছাপা হয়, তাদের নৈতিক দায়িত্ব নিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের ভুল সংশোধন ও সঠিক শিক্ষাক্রমের বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। তিনি বলেন, এখন আর আগের মতো রাজনৈতিক দলের হরতালে মানুষের সাড়া মেলে না, ছাত্র আন্দোলনও জোরদার নয়। তারপরও তারুণ্য জেগে আছে। পাঠ্যপুস্তকের এবারের ভুলগুলো গণমাধ্যমের আগে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে চলে আসে। তরুণ সমাজ এখনও সক্রিয়। তরুণ সমাজ পাঠ্যপুস্তকে ভুলের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। আমরা সেই তারুণ্যের ওপর আস্থা রাখব।

এএন রাশেদা বলেন, পাঠ্যবইয়ের ভুলের পেছনে জাতীয় রাজনীতিই আসল। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি আমাদের সংবিধান অনুসারে হয়নি। তিনি বলেন, ৩০টি মাদ্রাসাকে মডেল মাদ্রাসায় রূপান্তরে এডিবি টাকা দেয়। সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কেন দেয় না? সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, আগে শিক্ষার প্রতিটি বিষয়ে ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা দাবি উঠত। ‘৬২ থেকে ‘৬৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষার প্রতিটি বিষয়ে ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনগুলো ছিল সরব। এখনকার সংগঠনগুলো সেই ভুলগুলো আর বের করে আনতে পারছে না। অভিভাবক রোমানা ইয়াসমিন বলেন, পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকলে তো শিশুরা ভুলই শিখবে। সেটাই অনুসরণ করবে। আমরা অভিভাবকরা চাই, পাঠ্যবই নির্ভুল হোক।

অভিভাবক কেশব সরকার বলেন, এবার বইয়ে ছাপা হয়েছে ‘চাষা ভাই করে চাষ কাজে নেই হেলা’। চাষির পরিবর্তে চাষা শব্দটি কেন ছাপা হলো, আমার ছোট্ট শিশুটি তা জানতে চায়। শিক্ষক খায়রুল ইসলাম বলেন, ছাপার অক্ষরে পাঠ্যবইয়ে যা থাকে আর শিক্ষকরা যা বলেন দুটোই শিশু শিক্ষার্থীরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। তাই তাদের বইয়ে ভুল মেনে নেওয়া যায় না। আমরা নিজেই তাদের মূল পাঠ্যবই পড়তে চাপ দিই। সেখানে ভুল থাকলে কার কাছে মুখ দেখাব?

সাংবাদিক সাবি্বর নেওয়াজ বলেন, ২০১০ সালে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যের পাঠ্যবই দেওয়ার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সবার মনোযোগ চলে গেছে বই ছাপানোর টেন্ডার, কাগজ কেনা, মুদ্রণ কাজ বিতরণ ইত্যাদি বাণিজ্যিক কাজের দিকে। কারিকুলাম উন্নয়ন ও নির্ভুল পাঠ্যবই শিশুদের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়টি দিন দিন গৌণ হয়ে পড়ছে। তপন কুমার দাস বলেন, এবারের মতো ভুল গত ১০ বছরে আর পাঠ্যবইয়ে হয়নি। উক্তিগত ভুল রয়েছে পাতায় পাতায়। যতিচিহ্নের ব্যবহার ব্যাকরণ মেনে হয়নি। পাঠ্যবইয়ের উন্নয়নে গণসাক্ষরতা অভিযানের পক্ষ থেকে গত বছর ২১ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সরকারকে দেওয়া হয়েছিল।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।