পাহাড়ে নারী শিক্ষায় আলো ছড়াচ্ছে, বিদ্যালয় জাতীয়করনের দাবি নেতৃবৃন্দের

Lama-Girls-Schoolনুরুল করিম আরমান : বান্দরবানের লামা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙ্গালি নারী শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে অবহেলিত দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় নারী শিক্ষায় আলো ছড়াচ্ছে এ বিদ্যালয়টি। শুধু পড়ালেখা নয়; খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক, সাহিত্য চর্চা, বাহ্যিক জ্ঞানসহ শিক্ষামূলক নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমেও এ বিদ্যালয়ের অবস্থান শীর্ষে। লামা শহরের প্রাণ কেন্দ্রেই বিদ্যালয়টির অবস্থান।
কোমলমতি ছাত্রিদের লেখাপড়ায় অত্যন্ত নিরিবিলি ও মনোরম পরিবেশ রয়েছে বিদ্যালয়টিতে। বিদ্যালয়ের সামনেই রয়েছে উপজেলা পরিষদ, নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়সহ সিনিয়র জুড়িসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত। এলাকার নারী শিক্ষাকে সামনে এগিয়ে নিতে ও গরীব অভিভাবকদের সুবিধার জন্য এগিয়ে চলেছে এ বিদ্যালয়। তবে এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে ছাত্রী হোস্টেল না থাকায় দূর-দূরান্তের ছাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন। এ বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হলে অবহেলিত পাহাড়ি এলাকার নারী শিক্ষা আরও অগ্রগতি হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। বিধায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণ করার জোর দাবী জানিয়েছেন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সালে তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল বান্দরবানের লামা উপজেলায় নারী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁর এ উদ্যোগে এতদাঞ্চলে নারী শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্দি করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন- উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম মো. আলী মিয়া, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ইউনুছ, মরহুম এডভোকেট মোজাম্মেল হক, মরহুম আবদুর রশিদ ও আবু মুছা ফারুকী, লামা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আবদুল মালেক। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। মাত্র ১৮জন ছাত্রী নিয়ে এ বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে সর্বমোট ছাত্রী সংখ্যা ৬৫৭জন। তম্মধ্যে বান্দরবান সদর, রুমা ও থানছি উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের ৪০জন গরীব ছাত্রী এ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষক ও ৬ জন বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী কর্মরত আছেন। রয়েছে ৩ একর জমি। এখানে কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞানারগার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাশ রুম ও লাইব্রেরী রয়েছে। সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম যেমন- বিতর্ক, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ও নানা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় নিয়মিত এ বিদ্যালয়ে।
১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারী এমপিও ভুক্ত হয়ে নিম্ম মাধ্যমিক ও একই সালের ১ জুলাই মাধ্যমিকের অনুমতি পায় বিদ্যালয়টি। বর্তমানে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়টির ক্লাস কার্যক্রম চলে। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে যাঁরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের অনেকেই জীবিত নেই। এরা হচ্ছেন, মরহুম মো. আলী মিয়া, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মরহুম আবদুর রশিদ ও মরহুম এড. মোজাম্মেল হক এবং লামা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আবদুল মালেক। এখন সার্বিকভাবে সহযোগিতা আছেন- উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ ইসমাইল। বর্তমানে তিনি বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আজিজুর রহমান, বান্দরবান জেলা পরিষদ সদস্য ফাতেমা পারুল, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মাহাবুবুর রহমান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী করিমুল মোস্তফা স্বপন, পৌরসভার কাউন্সিলর মোহাম্মদ রফিক ও মো. আবু তাহের। মহি উদ্দিন সাঈদী, ফরহাদ হায়দার ও হামিদা আক্তার শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে আছেন। বিদ্যালয়টিতে প্রতিষ্ঠাকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন- সামছুল আনোয়ার। বর্তমান প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন, এ.এম. ইমতিয়াজ। তিনি ২০১৬ সালে বান্দরবান জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। মূলত তিনিই সাফল্যের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে বিদ্যালয়টির ঐতিহ্যের হাল ধরে রেখেছেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ.এম ইমতিয়াজের নেতৃত্বে এমপিওভুক্ত আরও ১৪জন ও খন্ডকালীন ১জন শিক্ষক এ প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করে যাচ্ছেন। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় ২০১৫ সালে ১৪৬জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ১৩০জন পাস করেছে। তন্মধ্যে ৪জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। পাশের হার ৮৯%। এসএসসি পরীক্ষায় ৮৭ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ৮০জন কৃতকার্য হয়েছে। এদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২জন, পাসের হার ৯২%। এ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন কৃতী ছাত্রি মারজানা আক্তার ও উম্মে সালমা স্বর্ণা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত। এছাড়া সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরী করছেন এ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। ২০১৬ সালের জাতীয় পর্যায়ে গ্রামীণ খেলাধূলায় স্কিপিং এ দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে বিদ্যালয়টি। ছাত্রীদের লেখাপড়ায় গতিশীলতা এবং আরও মনযোগি করে তুলতে আয়োজন করা হয়ে থাকে, মা ও অভিভাবক সমাবেশ।
এছাড়া ছাত্রীদের বাহ্যিক জ্ঞান, প্রতিভা বিকাশ ও উদ্যোমী করে তুলতে দেওয়ালিকা প্রকাশ, বিতর্ক ও দাবা প্রতিযোগিতাসহ জাতীয় দিবসগুলো যথাযথ ভাবে পালন করা হয় এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিদ্যালয়টি সকল শিক্ষক তাদের মেধা, শ্রম ও আন্তরিকতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক গড়ে তুলতে ও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে বছরের প্রথম থেকেই শুরু করে পাঠদান কার্যক্রম ও পরিকল্পনা। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুরের পতœী বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কর বিতরনী অনুষ্ঠানে একটি ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণের ঘোষনা দেন। এ প্রেক্ষিতে দুই কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি পূর্বক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে বলে বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক একটি আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব তৈরির কাজ চলমান। এছাড়া বিদ্যালয়টি জাতীয় করণের জন্য চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারী মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে ডিওলেটারসহ আবেদন করা হয়। জাতীয়করণ করা হলে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সুযোগ সুবিধা পাবে বলে বিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে। এতে করে অবহেলিত ওইসব এলাকার অভিভাবকরা তাদের কন্যা সন্তানদের শিক্ষায় আরও আগ্রহি হয়ে উঠবেন।
বিদ্যালযের ছাত্রী অভিভাবক আবদুল শহীদ ও মো. ইসহাক বলেন, উপজেলা সদর থেকে আমাদের বাড়ি ১০ কিলোমিটার দূরে রুপসীপাড়া বাজার এলাকায় অবস্থিত। তাই আমাদের মেয়েরা প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাওয়া আসায় চরম দুর্ভোগে পড়ে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় সময়মত গাড়ি পাওয়া যায়না। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বর্ষা মৌসুমে বেশির ভাগ সময একেবারেই যাওয়া সম্ভব হয় না। বিদ্যালয়ে একটি ছাত্রী হোস্টেল করা হলে এ দুর্ভোগ লাঘব হত এবং আমাদের মত দুর্গম পাহাড়ি এলাকার অভিভাবকরা তাদের কন্যা সন্তানদের শিক্ষা দিক্ষায় এগিয়ে নিতে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠত।
বিদ্যালয়ে ছাত্রী হোস্টেল না থাকার কারনে দূর-দূরান্ত ছাত্রীদের ভোগান্তির সত্যতা স্বীকার করে প্রধান শিক্ষক এ.এম ইমতিয়াজ জানান, এখান থেকে পড়াশোনা করে অনেক কৃতি ছাত্রী দেশবরেণ্য হয়েছেন। বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি ছাত্রী হোস্টেল নির্মান করা হলে শিক্ষা বন্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব হবে

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।