চবিতে এক বছরে ছাত্রলীগের ৮ দফা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের চলমান সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছয় নেতাকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। রোববার সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই ছয় নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানানো হয়। বহিষ্কৃতরা সবাই চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাসির ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুর অনুসারী।
বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মো. রকিব উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু তোরাব পরশ, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আরমান মিয়া, আপ্যায়ন সম্পাদক মিজানুর রহমান, সদস্য সাইদুল ইসলাম সাঈদ ও আরেফুল হক অপু।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও সংঘর্ষের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমটিন প্রধান কাজী এনায়েত জানিয়েছেন,‘দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে যাচাই বাছাইয়ের পর ওই ছয় নেতাকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে।’ তিনি আরো জানান, ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, সংঘর্ষের জন্য দায়ী, সংগঠন বিরোধী কর্মকাণ্ডসহ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আরো কিছু পদক্ষেপ নিবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয় ২০১৫ সালের জুলাই মাসে। এতে বর্তমান মেয়র গ্রুপ থেকে সভাপতি এবং সাবেক মেয়র গ্রুপ থেকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। চারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ায় বছর যেতে না যেতেই ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিটি স্থগিত করে কেন্দ্রীয় সংসদ। কমিটি স্থগিত করার এক ঘণ্টা পার না হতেই আবারো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিবাদমান দুটি পক্ষ। এভাবে বছরের শুরুটা শুরু করেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক দিয়াজের মৃত্যু ও ছয় নেতার বহিষ্কারের মধ্যে দিয়ে শেষ হচ্ছে ছাত্রলীগের সংঘাতময় এক বছর।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে অন্তত ৮ বার। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে এই ৮ বার সংঘর্ষে কারও দুই হাত, পিঠ ও আঙুল থেঁতলে দেয়া হয়েছে আর কারও মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। এছাড়াও রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় জীবন দিতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীকে। এমন দাবি দিয়াজের অনুসারী ও পরিবারের।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিসের সামনে ও শাহ আমানত হলে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজন গ্রুপ। এ সংঘর্ষে আহত হয় ৬ জন। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে আবারো সংঘর্ষে জড়ায় তারা। এতে তিনজন আহত হয়। এসময় শাহ আমানত হলের ১১১ থেকে ১১৪ নম্বর কক্ষে ভাঙচুর চালানো হয়।
এ অবস্থায় ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ২০১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সংসদ। এতে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন ত্যাগী নেতা বাদ পড়ে যায়। এজন্য সভাপতি টিপু ও সাধারণ সম্পাদক সুজনকে অভিযুক্ত করে পদ না পাওয়া ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলন নামে। আন্দোলনকারীরা কমিটি প্রত্যাখ্যান করে বিশ্ববিদ্যালয় তিনদিন ধরে অবরোধ করে রাখে। এমনকি ২০ জুলাই রাতে প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পদপ্রাপ্তদের গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বয়ং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রামে এসে বাদ পড়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নামের তালিকা নিয়ে যান। পরে ১ আগস্ট ২৬০ সদস্য বিশিষ্ট পুনরায় বর্ধিত কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। বর্ধিত কমিটি গঠনের এক মাস না যেতেই ৪ অক্টোবর আবারো মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক সংগঠন ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স) ও একাকার গ্রুপ। এসময় ভিএক্স কর্মীরা একাকার পক্ষের নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপ-ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শাহীনকে কুপিয়ে আহত করে। কোপ প্রতিহত করতে তার হাতের আঙ্গুল কেটে যায়। ২৯ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুর রব হলের মাঠে বগিভিত্তিক সংগঠন বাংলার মুখের নেতাকর্মীরা মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কুপিয়ে জখম করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তায়েফুল হক তপুকে। ওই ঘটনার রেশ ধরেই পরদিন ৩০ অক্টোবর অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মামুন ও আরেক নেতা নাজিমের বাসায় ভাঙচুর চালায়। ২০ নভেম্বর ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট এলাকার ভাড়া বাসায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় পরিবার দাবি করে আসছে, দিয়াজকে হত্যা করে তার মরদেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। গত ২৪ নভেম্বর ভর্তিচ্ছু এক শিক্ষার্থী কলা অনুষদে সাক্ষাৎকার দিতে গেলে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ওই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী যেন ভর্তি হতে না পারে তাই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজনের অনুসারী ছিলেন। ৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা। এসময় অফিসের ডেপুটি রেজিস্টারকে মারধরও করা হয়। ৮ ডিসেম্বর জুনিয়র সিনিয়রকে সালাম না দেয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেলের আঘাতে অন্তত ১৫ জন আহত হয়। এর মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ৯ ডিসেম্বর আগের রাতের ঘটনার জের ধরে তাদের মধ্যে পুনরায় সংঘর্ষ হয়। পরে দুপুরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শাহজালাল ও শাহ আমানত হলে তল্লাশি চালানো হয়। আটক হয় ৩০ জন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৪ জনের একটি দল তদন্ত করতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। এ সময় আ.জ.ম নাছির গ্রুপের দিয়াজ অনুসারী দুইজন নেতাকে সভাপতি আলমগীর টিপু গ্রুপের সদস্যরা মারধর করে।
Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।