কোচিং বাণিজ্য যেমন চলছিল, তেমনি চলছে


ড. ফ. র. মাহমুদ হাসান : গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ‘এ দেশের কোচিং ব্যবসা’ পড়লাম। ভোরে হাঁটা আমার অভ্যাস। যেখানেই যাই না কেন, ভোরে হাঁটতে গিয়ে এখনও দেখি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সেই কাকভোরে, ৬টা-সাড়ে ৬টার দিকে বুকে-পিঠে বইপত্র নিয়ে ছুটছে। জিজ্ঞেস করলেই জানায়, ‘প্রাইভেট’ পড়তে যাচ্ছে বা কোচিংয়ে যাচ্ছে। এরা প্রধানত ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস সেভেনের ছাত্রছাত্রী। হ্যাঁ, ক্লাস ওয়ান-টু-থ্রির শিশুরাও নিয়মিত ‘প্রাইভেট’ পড়ে। ‘প্রাইভেট পড়ে না বা কোচিংয়ে যায় না, এমন শিক্ষার্থী বলতে গেলে নেই। বেতন প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি ৩০০ টাকা। এদের বাবারা পরের জমিতে কাজ করে, ভ্যান চালায়, ইটখোলায় কাজ বা দোকানদারি করে। মায়েরা ক্ষেতে, মিলে বা পরের বাড়িতে কাজ করে। একেক ব্যাচে ১০ থেকে ২০-২৫ জন পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী পড়ে। কোনো কোনো শিক্ষক সকালে দুই ব্যাচ পড়ান আবার বিকেলে দুই ব্যাচ। এদের বেশিরভাগই হয় সরকারি স্কুলের, নয়তো এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। তবে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রও আছে, যারা প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়ায়।

একেবারে নিচু শ্রেণির শিশু হলে সেই সকালে মায়েরা খানিকটা পথ এগিয়ে দেন। পথে একজন সঙ্গী পেলে তার সঙ্গে ছেড়ে দিয়ে নিরাপদবোধ করেন। প্রায় সব জেলাতেই এই ধারা কমবেশি একই রকম। যেখানেই গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেছি, এত নিচের ক্লাসের শিশুকে প্রাইভেট পড়তে পাঠান কেন? বিভিন্নজন বলেছেন, ‘পাস করতে হলে প্রাইভেট পড়তে হয়; প্রাইভেট না পড়লে পিছিয়ে পড়বে; ও একটু দুর্বল বা ওর মেধা কম; আমরা তো আর ভালো খাওয়াতে পারি না যে মেধা হবে, তাই প্রাইভেটে পড়াতে হয়।’ সিক্স-সেভেনের শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শিক্ষকরা ক্লাসে কোনো চ্যাপ্টার ধরে পড়া শুরু করে শেষ করেন না; কোনো কিছু বোঝান না। বলেন, ‘কোচিংয়ে এসো, ভালো করে বুঝিয়ে দেব।’ অথচ এই শিক্ষকরাই সমাজে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ বলে চিহ্নিত। গত ২০ বছরে প্রতি সরকারের সময়ে এদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনের পক্ষে সর্বস্তরের মানুষ সহানুভূতি জানিয়েছে। এদের পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি সরকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বা যে কারণেই হোক, সরকারের বোধোদয় হয়নি যে, এসব ছাড়ের সঙ্গে শিক্ষকদের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার জায়গাটি যুক্ত করা বা সুদৃঢ় করা সম্ভব। এই জবাবদিহির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া দরকার। 

শিক্ষক দায়বদ্ধ থাকবেন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শেখা নিশ্চিত করতে। শিক্ষার্থীরা কী শিখল বা কতটা শিখল, তার মূল্যায়ন যেমন শ্রেণিকক্ষে অব্যাহত মূল্যায়নের মাধ্যমে হবে, তেমনি হবে সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু শিক্ষক যদি আদিষ্ট হয়ে সমাপনী পরীক্ষায়ও সাজানো নম্বর দিতে অভ্যস্ত হয়ে যান, তাহলে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক দুয়েরই বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সর্বশেষে বলতেই হয়, শিক্ষক যদি তার কাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে দায়বদ্ধতার প্রতিপালন বা ‘কমপ্লায়েন্স’ নিশ্চিত করতে কী করতে হবে সেটা সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের জবাবদিহির বিষয়। দ্বিতীয়ত, ‘শেখা’ ও ‘শেখানো’ সম্পর্কে ধারণাটা শিক্ষক, তত্ত্বাবধান ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সাধারণ মানুষ সবার কাছেই স্পষ্ট হতে হবে। ‘শেখানো’ অর্থ শিক্ষকের সিলেবাস শেষ করা নয়। তেমনি ‘শেখা’ অর্থ মুখস্থ করা নয়, প্রশ্নোত্তর শেখা নয় বা শূন্যস্থান পূরণও নয়। এমনকি গাইড বইয়ে দেওয়া সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে তা পরীক্ষার খাতায় লিখে তথাকথিত জিপিএ ৫ বা গোল্ডেন জিপিএ পাওয়াও নয়। শেখা অর্থ বয়স উপযোগী নির্ধারিত এবং যথাবিহিত জ্ঞান ও দক্ষতা আয়ত্ত করা, জানা এবং তা করতে পারা।

তৃতীয়ত, শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষের গুটিকতক বিশেষ করে যারা মেধাবী বলে পরিচিত শুধু তাদের নয় বরং প্রত্যেক শিশুর অর্জন নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভর্তির পরপরই শিক্ষককে প্রত্যেক শিশুর অর্জন দক্ষতা মূল্যায়ন করতে হবে এবং এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে শ্রেণিকক্ষে প্রতিটি শিশুর পাঠদান পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে প্রত্যেক শিশু তার নিজস্ব গতি, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে পারে। ‘শেখা’র বিষয়টা একটু ভেঙে বলার কারণ :শিক্ষকতার লক্ষ্য ‘পাঠদান’ নয় বা ‘সিলেবাস শেষ করা’ নয়। বড় দাগে বললে, শিক্ষকতা অর্থ- ১. প্রত্যেক শিশুর চাহিদা অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষে ভয় বা হুমকিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও শেখানোর কার্যকর ব্যবস্থাপনা করতে পারা; ২. শিক্ষাক্রম ও বিষয়ের গুরুত্ব অনুযায়ী সময় বিভাজন অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ভাষা দক্ষতা অর্জনে সবচেয়ে বেশি সময় বরাদ্দ করা এবং প্রায় ততখানি সময় গাণিতিক দক্ষতা ও বিজ্ঞানে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য দেওয়া এবং ৩. শিশুরা শুধু টেক্সট বই পড়া এবং প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করার পরিবর্তে যাতে দেখে-ধরে-করে শেখার সুযোগ পায়, শ্রেণিকক্ষে তার ব্যবস্থা করা। তাহলেই প্রত্যেক শিশুর কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করা হবে।

শিক্ষকরা নিজেদের, বিশেষ করে শিক্ষক সংগঠনের নেতারা তাদের সদস্যদের ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ বলে বর্ণনা করতে ভালোবাসেন। তাই তো হওয়ার কথা ছিল! নতুবা কোটি কোটি শিশুসন্তান ও শিক্ষার্থীকে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে যে কোনো বিষয়ের যে কোনো অধ্যায়ের দু’একটা অনুচ্ছেদ পড়িয়ে দিয়ে যখন বলেন, ‘বাকিটা পড়ে নিও বা প্রাইভেট-কোচিংয়ে এসে বুঝে নিও’ বা যখন অভিভাবককে বলেন, ‘পাস করতে হলে প্রাইভেট পড়তে হবে, কোচিংয়ে আসতে হবে’; তারপরও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে পরের জমিতে খেটে খাওয়া বা পরের বাড়িতে কাজ করা অভিভাবকও তাকে বিশ্বাস করেন, তার ওপর আস্থা রাখেন? উচ্চ আদালতের রায়, টেলিভিশনের খবর ও আলোচনা এবং পত্রপত্রিকায় লেখালেখির পর এক মাসও কাটেনি; এখনও দেশের গ্রামাঞ্চলের সর্বস্তরের শিশুরা বইয়ের গাদা পিঠে তুলে প্রাইভেট পড়তে ছুটছে। 

একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে- ‘শেখা’র গুরুত্ব উপেক্ষা করে শুধু স্কুলে যাওয়ার যেমন কোনো অর্থ হয় না, তেমনি ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ শিক্ষক যদি তার অযোগ্যতা, অদক্ষতা বা নৈতিক স্খলনের কারণে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক শিশুর শেখা নিশ্চিত করতে অপারগতা প্রকাশ করেন বা ব্যর্থ হন, তাহলে শিক্ষকতার অর্থ কী? সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে? সরকার যদি শিক্ষককে তার কাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব পালনে সমর্থ করতে ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মা-বাবা, অভিভাবক ও পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে তার অদক্ষতা ও অসহায়ত্বের জন্য সরকারের একটা জবাবদিহির প্রশ্ন কি দাঁড়াবে না? তাহলে তাদের এবং দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে আদালত যদি সরকারের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন, তাহলে তা কি বড় অবিবেচনামূলক হবে? আর আদালত যদি প্রয়োজনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে সরকারের কাছে এই জবাবদিহি না চান, তাহলে কে চাইবে? সে ক্ষেত্রে শিক্ষক ও সরকারের জবাবদিহির প্রক্রিয়াটা কী হবে? স্বভাবতই, শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের শিক্ষা বিষয়ে ধারণা, বিবেচনা ও পরিকল্পনা কি মৌলিকভাবে ঢেলে সাজানোর প্রশ্ন উঠবে না? আর যতদিন তা সম্ভব না হচ্ছে, ততদিন স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা কি আদালতের রায় অগ্রাহ্য করে যথারীতি তাদের কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাবেন? 

শেষ করার আগে নোট ও গাইড বই সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলতে চাই। এ কাজের সঙ্গে দেশের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ ব্যবসায়ী মহল ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এমনকি সম্ভবত দেশের বেশিরভাগ সংবাদপত্রও। তবু আমার ধারণা, নোট ও গাইড বই প্রকাশনা এবং সব পর্যায়ে তার যথেচ্ছ ব্যবহার সমস্যার সমাধান সম্ভবত অপেক্ষাকৃত কম জটিল। তাই এ কাজটা দ্রুত শুরু করা যেতে পারে এবং কাজটা ড. জাফর ইকবালের নেতৃত্বেই হতে পারে। তিনি উদ্যোগ নিলে তার আহ্বানেই আমি যাকে বলি সাধারণ মানুষের সমাজ, তাদের সহযোগিতায় দুটি কাজই বেশ খানিকটা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

ড. জাফর ইকবাল শুধু দেশের একজন বরেণ্য ব্যক্তিই নন, তিনি একজন জনপ্রিয় লেখক, অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী। বিনীতভাবে তার উদ্দেশে বলি, আপনার ভক্ত যারা আপনার কথা ফেলতে পারেন না, সেসব সম্পাদক ও সাংবাদিককে নিয়ে বসুন না, তাদের সদিচ্ছা পরীক্ষা করতে নয়, বরং কাজটা শুরু করতে। একটা কাজ হতে পারে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষার্থীর শ্রেণি ও বয়স উপযোগী দক্ষতা অর্জনের গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে টেক্সট বই রচনার নতুন নির্দেশিকা তৈরি করে পরীক্ষিত এবং দক্ষ লোকের ছোট ছোট বিষয়ভিত্তিক দল করে- ১. বেশিরভাগ টেক্সট বই ঢেলে সাজানো। এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলে রাখা ভালো। এই কচি বয়সে আদর্শবান, সুনাগরিক এবং দেশপ্রেমিক হওয়ার দায়ভার শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে টেক্সট বই ভারাক্রান্ত না করে বরং শিশুরা সহজে পড়তে পারে, পড়ে আনন্দ পায়, একা একা বা বন্ধুদের সঙ্গে একজোট হয়ে, যেখানে-সেখানে বসে যখন-তখন পড়তে আগ্রহী হয়, এ রকম ধারণা মনে রেখে টেক্সট বই রচনা বেশি ফলপ্রসূ হবে। শিশুরা যত জানবে, বুঝবে, দেশ ও দেশের মানুষকে তত ভালোবাসবে। তত বিনম্র হবে। ২. প্রয়োজনে একাধিক সহযোগী উপকরণ প্রণয়ন ও বাজার থেকে বয়স উপযোগী আকর্ষণীয় গল্পের বই সংগ্রহ। এই উদ্যোগের প্রথম এবং দৃষ্টান্তমূলক কাজ হবে সব পত্রপত্রিকা থেকে নোট বই ও গাইড বইয়ের আঙ্গিকে গড়ে তোলা পৃষ্ঠাগুলোর অবলুপ্তি।

শিক্ষাবিদ

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।