করোনা কেড়ে নিল ঢাবিতে পড়া মেধাবী ছেলেকে

Image

খুলনা প্রতিনিধি,৩১ আগষ্ট ২০২১:
কাঁকড়া ধরে জীবিকা চলে। সেই পরিবারের ছেলে ধনঞ্জয় মণ্ডল পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রত্যন্ত গ্রামটির আর কারও নেই এমন কীর্তি। বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেন আশার আলো হয়ে উঠেছিলেন। সেই আলো নিভে গেল চারপাশে দ্যুতি ছড়ানোর আগেই।

জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ২৪ আগস্ট মারা যান ধনঞ্জয়। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে মা–বাবা, ভাইসহ পরিবারের সবাই স্তম্ভিত। এমন মৃত্যু মানতে পারছেন না খুলনার কয়রা উপজেলার গড়িয়াবাড়ি গ্রামের কেউই।

ধনঞ্জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় ভাইভা পর্যন্ত যান। ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় টিকেছেন। ভাইভার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন জোরেশোরে।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম গড়িয়াবাড়ি। কয়রা সদর ইউনিয়নের গ্রামটি উপজেলার পূর্ব দিকের সর্বশেষ জনবসতি। এই গ্রামের বাসিন্দা অর্জুন মণ্ডলের ছেলে ধনঞ্জয়। অর্জুনের তিন ছেলে। ছোট ছেলে বিজন মণ্ডল খুলনা বিল কলেজে পড়াশোনা করেন। মেজ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া ধরেন অর্জুন। দুজনে মিলে যা আয় করেন, তা দিয়ে চলে সংসার। টাকা বাঁচিয়ে বহু কষ্টে তাঁরা ধনঞ্জয় ও বিজনকে পড়াশোনার সুযোগ করে দেন।

ধনঞ্জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচাতে ছিলেন সংকল্পবদ্ধ। সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পথে বেশ ভালোই এগোচ্ছিলেন। ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় ভাইভা পর্যন্ত যান। এরপর নিজেকে আরও বেশি প্রস্তুত করে নেন। ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় টিকেছেন। ভাইভার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন জোরেশোরেই। করোনা পরিস্থিতিতে বাড়িতে থেকেই পড়াশোনায় মগ্ন ছিলেন তিনি। সেই ধনঞ্জয় সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

মেধাবী ও শান্ত হওয়ায় এমনিতেই এলাকার সবার কাছে পরিচিত ছিলেন ধনঞ্জয়। হঠাৎ এমন মৃত্যু তাঁকে আরও বেশি পরিচিত করে তুলেছে। সেটি বোঝা গেল সোমবার বিকেলে ধনঞ্জয়দের বাড়িতে যাওয়ার সময়। তাঁর কথা বলতেই বহুদূরের মানুষজনও একবাক্যে জানিয়ে দিচ্ছিলেন বাড়ির ঠিকানা।

গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী। নদীর অপর পারে সুন্দরবন। নদী ও সুন্দরবনকে বাঁ পাশে রেখে ছোট ইটের রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে এগোলেই ধনঞ্জয়দের বাড়ি। নিচে পাকা ভিত। ওপরে কাঠের ঘরে টিনের ছাউনি। বিকেল গড়িয়েছে; তবু বাড়িতে মানুষের জটলা। ভিড় ঠেলে ধনঞ্জয়ের ঘরে গিয়ে দেখা গেল, তাঁর স্ত্রীর কোলে ঘুমাচ্ছে পাঁচ মাস বয়সী ছেলে ধ্রুবজয় মণ্ডল। অঝোরে কাঁদছেন স্ত্রী সাগরিকা সরকার। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন অন্যরা।

শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা খুব কম যায়। দ্রুত সিলিন্ডার অক্সিজেন আনা হয়। সেই অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে আরেকটি সিলিন্ডার আনার চেষ্টা চলছিল। এর ফাঁকে বেলা একটার দিকে মারা যান ধনঞ্জয়।
মানিক মণ্ডল, ধনঞ্জয়ের মেজ ভাই
একই গ্রামের মেয়ে সাগরিকা। ২০১৯ সালে তাঁকে বিয়ে করেন ধনঞ্জয়। পাঁচ মাস বয়সী ছেলেকে নিয়ে যেন অকুল পাথারে পড়েছেন সাগরিকা। মৃত্যুর পর সাত দিন গেলেও থামছে না ধনঞ্জয়ের মা–বাবা, ভাইয়ের কান্না।

মেজ ভাই মানিক মণ্ডল বলেন, কয়েক দিন আগে হালকা জ্বর আসে ধনঞ্জয়ের। গ্রাম্য এক চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে খাচ্ছিলেন। ২৩ আগস্ট রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তবে পরদিন ভোরের দিকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। সকালে ভাত খেয়ে ঘরের বাইরে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসেন। ততক্ষণে শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। চিকিৎসক এসে পরীক্ষা করে দেখেন, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা খুব কম। দ্রুত বাড়তি অক্সিজেন দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। পাশের এক জায়গা থেকে সিলিন্ডার অক্সিজেন আনা হয়। সেই সিলিন্ডারের অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে আরেকটি আনার চেষ্টা চলছিল। এর ফাঁকে বেলা একটার দিকে মারা যান ধনঞ্জয়। তাঁর আর কোনো অসুখ ছিল, এমনটা জানা নেই পরিবারের কারও।

ধনঞ্জয়ের স্ত্রী সাগরিকা স্নাতক পাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যরা চাইছেন, সাগরিকার জন্য একটা চাকরি। সেটি হলে বেঁচে যাবে পরিবারটি। মানুষ হতে পারবে ধনঞ্জয়ে ছোট্ট শিশুটি।

ধনঞ্জয়ের চাচাতো ভাই বিভূতি মণ্ডল পড়াশোনা করেন খুলনা সরকারি বিএল কলেজে। তিনি বলেন, ধনঞ্জয়ের মতো মেধাবী ছাত্র এই এলাকায় নেই। সবাই তাঁর দিকে চেয়ে ছিলেন। সেই আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। এখন তাঁর স্ত্রীও যদি চাকরি পান, তাহলে পরিবারটি দাঁড়াতে পারবে। এ জন্য ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি তিনি অনুরোধ জানান।
প্রথম আলো

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।