স্টাফ রিপোর্টার: আপাতত রাসায়নিক ব্যবহার না করে ফোম ও চটের বস্তা দিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় ছড়িয়ে পড়া জ্বালানি তেল সরানোর পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ, যাতে কাজে লাগানো হবে জেলে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের। আর এ কাজে এলাকাবাসীকে উৎসাহী করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে দুটি পারচেইজিং সেন্টার খুলছে পদ্মা অয়েল কর্তৃপক্ষ। গ্রামবাসী নদী আর খাল থেকে সংগ্রহ করা তেল ওই ক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করতে পারবে।
এছাড়া তেল যাতে আরো ছড়াতে না পারে, সেজন্য চাঁদপাই রেঞ্জে শেলা নদীর যে এলাকায় তেলবাহী ট্যাংকার ডুবেছিলো, তার আশপাশের খালের মুখ জেলেদের সহযোগিতায় জাল দিয়ে আটকে দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসাইন চৌধুরী।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের টাগবোট কান্ডারি-১০ তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণে ১০ হাজার লিটার অয়েল স্পিল ডিসপারসেন্ট ঘটনাস্থলে পৌঁছুলেও এখনই রাসায়নিক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান মো. শামসুদ্দোহা খন্দকার জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তিনদিন গ্রামবাসীর সহায়তা নিয়েই তেল সংগ্রহের চেষ্টা হবে। পরে রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুত কেন্দ্রে যাওয়ার পথে গত মঙ্গলবার ভোরে দুর্ঘটনায় পড়ে ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাঙ্কারটি। এমটি টোটাল নামে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং সেটি ডুবতে শুরু করে। সাউদার্ন স্টারে থাকা সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলের প্রায় পুরোটাই ইতোমধ্যে সুন্দরবনের নদী ও খালে ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা। আর পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই তেল বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিন এবং বনের প্রাণ বৈচিত্র্য জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
দুর্ঘটনার ৫৫ ঘণ্টা পর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খান জাহান আলী স্যালভেজ এন্টারপ্রাইজের সহযোগিতায় আধাডোবা সাউদার্ন স্টারকে টেনে এক কিলোমিটার দূরে জয়মনির একটি চরে নিয়ে গেছে ট্যাঙ্কারের মালিক প্রতিষ্ঠান হারুন অ্যান্ড কোম্পানি। স্যালভেজ কোম্পানির বার্জ বিডি রাইজিং ও তিনটি উদ্ধারকারী জাহাজ স্থানীয় ডুবুরিদের সহায়তা নিয়ে সকাল ১০টার দিকে ট্যাঙ্কার উদ্ধারের কাজ শুরু করে। বেলা ১২টার দিকে সেটি টেনে নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে জয়মনির একটি চরে রাখা হয় বলে খান জাহান আলী স্যালভেজ এন্টারপ্রাইজের মালিক আবুল কালাম জানান। তেল অপসারণে করণীয় নির্ধারণে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্মেলনকক্ষে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে বন বিভাগ, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জাহাজ মালিকের প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা হয়। সেখানেই স্পঞ্জ ও চট ব্যবহার করে স্থানীয়দের দিয়ে তেল অপসারণ শুরুর সিদ্ধান্ত হয় বলে মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভূইয়া জানান।
বিআইডব্লিউটি’র চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা সাংবাদিকদের বলেন, দেড় বছর আগে বিষখালী নদীতে এক জাহাজডুবির ঘটনায় তেল ছড়িয়ে পড়েছিলো। তখনও স্পঞ্জ দিয়ে তেল সরানোয় ভালো ফল পাওয়া গিয়েছিলো। সুন্দরবনে রাসায়নিক ব্যবহার করা হলে তাতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে কি-না- সে প্রশ্ন তুলে এ বিষয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়া উচিত বলে বৈঠকে মত দেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসাইন। এরপরই প্রাথমিকভাবে ফোমের মাধ্যমে তেল সংগ্রহের প্রস্তাব দেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান। শেষ পর্যন্ত ওই সিদ্ধান্ত নিয়েই সভা শেষ হয়।
এ বিষয়ে সার্বিক তদারকির দায়িত্বে থাকা নৌ-মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলাম ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, কাণ্ডারি-১০ যে অয়েল স্পিল ডিসপারস্যান্ট নিয়ে গেছে তা ছিটিয়ে দিলে ভাসমান তেলের রাসায়নিক গঠন ভেঙে যাবে এবং ভেসে থাকা তেল পানির নিচে চলে যাবে। এতে পানির অক্সিজেন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমবে।
পানিতে ভাসমান তেল অপসারণের এ পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বলেও তিনি দাবি করেন। কাণ্ডারি-১০’র মাস্টার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, কর্ণফুলী নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ার অন্তত ২০টি ঘটনায় তারা এ রাসায়নিক ব্যবহার করেছেন। কোথাও পরিবেশের কোনো ক্ষতি তারা দেখতে পাননি।
এদিকে তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকাটি সরকার ঘোষিত ডলফিনের অভয়ারণ্য। এছাড়া সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। জাতিসংঘের ওই দু সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতর এ এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। বন বিভাগ থেকে একাধিকবার এবং জাতিসংঘের জলাভূমি বিষয়ক সংস্থা রামসার কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞান-শিক্ষা ও ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো থেকে নৌপথটি নিয়ে আপত্তি তুলে তা বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পলিন টেমেসিস বুধবার এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধে সরকারের কাছে আবার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ধরনের বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চললে তা দীর্ঘ মেয়াদে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে।
পলিন টেমেসিস বলেন, সুন্দরবনের যে এলাকাটিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে এটি বিশ্বের বিপদাপন্ন দু প্রজাতি গাঙ্গেয় ও ইরাবতি ডলফিনের বিচরণক্ষেত্র। এছাড়া অনেক সমৃদ্ধ জলজ প্রাণী রয়েছে সেখানে। সুন্দরবন ইউনেসকো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। তাই সুন্দরবনের ভেতরে এই দুর্ঘটনায় জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সুন্দরবনের ভেতরে জাহাজডুবিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে নির্লিপ্ত থেকে তার সুরক্ষার পরিবর্তে বনের ভেতর দিয়ে বড় নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। এ দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য যথেষ্ট যে, সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও তা কতটা অরক্ষিত এবং এর নিকটবর্তী নদী দিয়ে তেল, কয়লা বা বিষাক্ত বর্জ্য পরিবহন কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।
এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ এবং এর পাশে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন যে কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে তার কিছুটা লক্ষণ এ দুর্ঘটনা থেকে দেখা গেলো। সরকার এখনই যদি নৌপথ বন্ধ না করে এবং রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনের পাশ থেকে সরিয়ে না নেয় তাহলে আমরা সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাব তো বটেই এক সময় বনটিই ধ্বংস হয়ে যাবে।
শ্যালা নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ: অন্যদিকে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদী রুটে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গত বুধবার রাতে সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে এ কথা জানানো হয়েছে।
তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, রাতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।