শিক্ষক নিয়োগে জাল সনদের ছড়াছড়ি

স্টাফ রিপোর্টার: বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে জাল সনদের ছড়াছড়ি চলছে। সরকারের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) ইতোমধ্যে এক হাজার জাল সনদ বাতিল করেছে। আর বলছে তাদের কাছে এখন পর্যন্ত যে অভিযোগ আছে তাতে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০ হাজারের বেশি জাল সনদধারী শিক্ষক আছে বলে তারা ধারণা করছেন। কারণ হিসাবে এ সংস্থার বক্তব্য এই যে, জালিয়াতির বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই দেখা যায় সত্য। জালসনদধারী শিক্ষকদের বরাত দিয়ে সরকারের ওই নীরিক্ষা সংস্থাটি বলছে, জালিয়াতির সঙ্গে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশ রয়েছে। অর্থাত্ সনদ যাদের দেওয়ার কথা তারাই জাল সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জড়িত।

প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের শর্তে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। আর এ জন্য নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ ( এনটিআরসিএ) গঠন করা হয়। এই কর্তৃপক্ষের বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যারা কৃতকার্য হন তারাই নিবন্ধন প্রত্যয়নপত্র পান। এই নিবন্ধন প্রত্যয়ন শিক্ষক নিয়োগের বিভিন্ন শর্তের একটি। সংস্থাটি গঠিত হবার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৪০ হাজার নিবন্ধন সনদপত্র দিয়েছে।

শিক্ষক হওয়ার মূল যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে শিক্ষক নিবন্ধনের মূল সনদ জমা দিয়ে আবেদন করেছেন, নিয়োগও পেয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। এমপিওভুক্ত হয়েছেন, গ্রহণ করেছেন সরকারি বেতন ভাতাও। কিন্তু দীর্ঘদিন পর অনুসন্ধানে জানা যায়, তার নিবন্ধনের সনদটিই জাল। নিয়োগ বোর্ডকে ফাঁকি দিয়ে, তথ্য গোপন করে বা নিয়োগ বোর্ডের কোনো কোনো সদস্যকে ঘুষ দিয়ে হয়েছেন শিক্ষক, নিজে অনিয়ম করে অন্যকে জ্ঞান বিতরণ করে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, একটি সিন্ডিকেট শিক্ষকদের মাঝে দীর্ঘদিন টাকার বিনিময়ে সনদ  বিতরণ করেছে, যা ভুয়া বা জাল।

ডিআইএ (পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর) কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘যে সব শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদের প্রমাণ মিলেছে তারা আমাদের জানিয়েছে, এই সনদ তারা এনটিআরসিএ থেকেই সংগ্রহ করেছেন। শিক্ষক হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সনদ তারা কিনেছেন ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে। সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের একটি অংশের যোগসাজশ ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়ও বলে মন্তব্য তাদের। এ কারণে এই সংস্থার কর্মকাণ্ড কঠোর মনিটরিংয়ের দাবি সংশ্লিষ্টদের।

জাল সনদ খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, টাকার বিনিময়ে মূল সফটওয়্যারে প্রার্থী ভুয়া নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর তৈরি করে তা আপলোড করতে ব্যর্থ হলেই তা জাল প্রমাণ মিলছে। কিন্তু ভুয়া রোল নম্বর সফটওয়ারে আপলোড করতে পারলে সেগুলো আর জাল হিসাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে না। ফলে অনেক জাল সনদধারীর সনদ জাল হিসাবে প্রমাণ করা যাবে না। জাল সনদ নিয়েই চাকরি করে যাচ্ছেন তারা। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর পরীক্ষার সময় উপস্থিতির স্বাক্ষর দেখলেই জাল না সঠিক তা প্রমাণ করা যাবে।

ডিআইএর উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান বলেছেন, গত প্রায় এক বছর ধরে তারা সনদ যাচাই করে যাচ্ছেন যেগুলোর বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছে কেবল সেগুলোই যাচাই করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারা এক হাজারের বেশি জাল সনদের প্রমাণ পেয়েছেন। এনটিআরসিএ-ই এগুলো জাল বা ভুয়া প্রমাণ করেছে। আরো যাচাইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে কয়েকশ। প্রতিনিয়ত তারা জাল সনদ পাচ্ছেন। সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জাল সনদধারী ভুয়া শিক্ষক। তার মতে, সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি জাল সনদধারী শিক্ষক রয়েছেন। সব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করলেই এর প্রমাণ মিলবে।

নরেশ চন্দ্র মণ্ডল নামে ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের একজন প্রভাষক। তিনি ২০১২ সালে এমপিওভুক্ত হয়েছিলেন একটি নিবন্ধন সনদ দেখিয়ে। যার রেজি নং- ৮০০১৮১১৯/২০০৮। ফল প্রকাশ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯। ৫০ শতাংশ নম্বর দেখিয়েছেন।

নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ প্রথমে নরেশ মণ্ডলের সনদটি জাল হিসেবে চিহ্নিত করেন ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর। এ কারণে বেতন হিসাবে নেয়া ৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা ফেরতযোগ্য বলে ডিআইএ । কিন্তু কয়েকদিন পর নরেশ চন্দ্র মণ্ডল পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে নতুন একটি সনদ জমা দিয়ে বলেন, এটি আমার প্রকৃত সনদ, যাচাই করে দেখুন ঠিক আছে। যে সনদটিকে সঠিক বলে দাবি করছেন তাতে নরেশের রোল নম্বর ১৫৭০৯৬৫। ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নরেশকে পাস দেখানো হয়েছে। নিবন্ধন নং ০৫৪০৯৫০৯/২০০৫। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে নরেশকে সঠিক সনদটি তৈরি করে দিলো কে? এই সনদটিও যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে ডিআইএ।

ডিআইএর ধারণা, এর মূল সফটওয়ারে থাকলেও নরেশ মণ্ডলের সনদটি জাল হতে পারে। এনটিআরসিএর জাল সনদ সিন্ডিকেটের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে তিনি এটি কিনতে পারেন এমন শঙ্কাও রয়েছে তাদের। এ কারণে সনদ জাল কিনা এমন তথ্য না চেয়ে কৌশল হিসাবে এনটিআরসিএর কাছে নরেশ চন্দ্র মণ্ডলের পরীক্ষার সময় উপস্থিতির স্বাক্ষর চেয়েছে সংস্থাটি। ডিআইএ’র মতে, জাল সনদ সঠিক বলে দিতে পারে এনটিআরসিএ। কিন্তু উপস্থিতির স্বাক্ষর জাল করা সম্ভব হবে না। এ কারণেই এ কৌশল নিয়েছে ডিআইএ।

ডিআইএ’র অপর এক কর্মকর্তা বলেন, এনটিআরসিএ’র কিছু কিছু কর্মকর্তার এর আচরণেও জাল সনদের সন্দেহ উস্কে দেয়। ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক রুবিনা বেগম, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এরশাদ আলীর সনদ জাল হতে পারে এমন সন্দেহ ডিআইএ’র। এ কারণে এই সনদগুলো পরীক্ষার জন্য এ পর্যন্ত ১০ বার এনটিআরসিএ’র কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তথ্য দেয়নি এনটিআরসিএ। ডিআইএ-এক কর্মকর্তা বলেন, ডিআইএ এবং এনটিআরসিএ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সরকারি সংস্থা। সব নিয়ম মেনেই তথ্য চেয়েছি । কিন্তু এভাবে সহযোগিতা না করার কারণে প্রকৃত জাল সনদের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি এভাবে ১০৫টি সনদের (জাল না সঠিক) বিষয়ে তথ্য না পাওয়ার অভিযোগ করেছে ডিআইএ। জাল সনদধারী শিক্ষকদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য মিলবে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

এনটিআরসিএ’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাও জাল সনদ তৈরিতে সিন্ডিকেট থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডে আমাদের কিছুটা সন্দেহ হয়। বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান হতে পারে। যাতে প্রকৃত সিন্ডিকেট ধরা পড়ে। জাল সনদের মুক্তি মেলে।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক তৌহিদুর রহমান বলেন, আমরা নতুন এসেছি। বিভিন্ন সংস্থা থেকে আমাদের কাছে সনদ যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়। আমরা যাচাই করে দেই। অনেক সনদ পেয়েছি যেগুলো জাল বা ভুয়া। জাল সনদ তৈরির ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ’র কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, অতীতে এমন অভিযোগ হয়তো ছিল। এখন নেই। যদি কেউ জাল সনদ দেওয়ার কাজে জড়িত থাকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।