এবার নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী দম্পতি সপরিবারে নিখোঁজ

ঢাকা: সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিসানে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের মধ্যে নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতার পর ব্যাপক সমালোচনার চাপে পড়ে দেশের স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ। এর মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে শোলাকিয়ায় ঈদগাহে বোমা হামলায় নিহত আরেক জঙ্গিরও পরিচয়ে মেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়টির সংশ্লিষ্টতা। জঙ্গিদের ‘আশ্রয়’ দেয়ার অভিযোগে রিমান্ডে আছেন খোদ প্রোভিসি। এরই মধ্যে ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী দম্পতি সপরিবারেই নিখোঁজের সন্ধান মিলেছে।

সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর পুলিশ এবং সরকারের পক্ষ থেকে ‘নিখোঁজ’ সন্তানদের বিষয়ে তথ্য জানাতে বলা হয়। পুলিশও এ ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব নিয়ে কাজ শুরু করে। নিখোঁজদের অনুসন্ধান করতে গিয়েই ওই পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। নিখোঁজ দম্পতি নাদীয়া ও শিশিরের সঙ্গে নিখোঁজ আছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রোকন উদ্দিন। ওই চিকিৎসক সরকারি চাকরি ছেড়ে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও মেয়ে জামাই নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন।

রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার ৪৪১/বি নম্বর বাড়ি (ডা. আলী আহম্মদ ভিলা) থেকে ২০১৫ সালের জুন মাসে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে সপরিবারে রওনা হন ডা. রোকন উদ্দিন (৫৫)।

ওই বাড়ির কেয়ারটেকারের হেলাল উদ্দিনের ভাষ্যমতে, ২০১৫ সালের জুন মাসে বাড়ির মালিক নাঈমা আক্তার (৩৭), তার স্বামী ডা. রোকন উদ্দিন (৫৫), মেয়ে নাদীয়া (২২), জামাই শিশির (২৮) এবং ছোটো মেয়ে রামিতা (১৫)। যাওয়ার দিন সকালে হেলাল উদ্দিন নিজেই ওই পাঁচটি লাগেজ গাড়িতে তুলে দেন। সে সময় রোকন উদ্দিন তাকে বলেছিলেন, ‘দেশ ভালো লাগে না। বিদেশ থেকে ঘুরে আসি। যদি কোনো মুসলিম দেশ ভালো লাগে, তাহলে সেখানেই থেকে যাবো। আর ভালো না লাগলে আবার ফিরে আসবো।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ডা. রোকন উদ্দিন জাতীয় শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। দেশ ছাড়ার মাসখানেক আগে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। স্ত্রী নাঈমা আক্তার কবি নজরুল ইসলাম কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। দেশ ছাড়ার এক বছর আগে তিনি যশোর এমএম কলেজে বদলি হন। তিনিও চাকরি ছেড়ে দেশ ছাড়েন।

ওই দম্পতির মেয়ে নাদিয়া আক্তার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ার সময় একই বিভাগের ছাত্র শিশিরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। উভয় পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়েও হয়। বিয়ের বছরখানেক পরেই পড়াশুনা শেষ না করে তারা বাবা-মার সঙ্গে দেশ ছাড়েন। আর ছোট মেয়ে রামিতা আক্তার পড়তো ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে।

দেশ ছাড়ার দু’মাস পরে রোকন উদ্দিন তার ভাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজের কাছে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমরা ভালো আছি। বর্তমানে মালয়েশিয়াতেই আছি।’ তবে এর পরে আর পরিবারের কারো সাথে যোগযোগ করেননি তিনি।

বাঁ থেকে: ছোট মেয়ে রামিতা, ডাক্তার দম্পতি, মেয়ে জামাই, বড় মেয়ে নাদিয়া

খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ তলা বাড়িটি নামী হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ডা. আলী আহম্মেদের নামে। মৃত্যুর আগে দুই মেয়ে নাঈমা ও হালিমার নামে বাড়িটি তিনি লিখে দিয়ে যান। বাড়িটির  নিচে একপাশে রয়েছে একটি ফার্মেসি। অন্যপাশে একটি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বার। চেম্বারটি নাঈমা আক্তারের বড় বোন হালিমা আক্তারের। আর বাড়ির বিপরীত দিকে রাস্তার অপর পাশে রয়েছে নাঈমা আক্তারের ভাই মর্তুজা কামালের ওষুধের দোকান। সেখান থেকে ফোন নম্বর নিয়ে মর্তুজার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এদিকে রোকন উদ্দিনের বাড়ির কেয়ারটেকারের ভাষ্য অনুযায়ী, সপরিবারে দেশ ছাড়ার আগে রোকন উদ্দিন তার বাড়িটি ভাতিজি শিখাকে দিয়ে যান। বর্তমানে বাড়িটির তৃতীয় তলায় দু’টি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন শিখা। তিনিও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।

এর আগেও ডা. রোকন উদ্দিন জাপান, সৌদি আরব, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন বলেও জানান ওই বাড়ির কেয়ারটেকার হেলাল উদ্দিন। তিনি জানান, ডা. রোকনের গ্রামের বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে।

রামপুরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিকুল ইসলাম নিখোঁজ ঐ চিকিৎসকের ভাই আফাজ উদ্দিনের বরাত দিয়ে বলেছেন, গত বছরের জুন মাসে ডা. রোকন উদ্দিন ও তার  স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক মেয়ের জামাই তুরস্ক যান। এরপর থেকে তারা দেশে ফিরেননি। ডা. রোকনের স্ত্রী মালিবাগের প্রখ্যাত হোমিও চিকিৎসক প্রয়াত আলী আহম্মেদের মেয়ে।

তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে না থাকার বিষয়টি রহস্যজনক। এর সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। বিষয়টি পুলিশের শীর্ষ পর্যায়কে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।

গত ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় অস্ত্রধারীরা ঢুকে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে হামলাকারীদের বোমা ও গুলিতে নিহত হোন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও গুলশান থানার ওসি সালাহউদ্দীন। আহত হন আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য।

ওই ঘটনার পর পিছু হটে পুলিশ; সারারাত পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা ক্যাফেটি ঘিরে রাখার পর সকালে সেখানে কমান্ডো অভিযান চালানো হয়। এরপর সেখান থেকে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। নিহত জঙ্গিদের মধ্যে নিবরাস ইসলাম নামের এক জঙ্গিকে পাওয়া যায়, যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। আবার শোলাকিয়ায় পুলিশের ওপর হামলা চালানোর সময় নিহত আবিরও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা দু’জনই দীর্ঘদিন বাড়ি থেকে নিখোঁজ ছিলেন। এ ঘটনার পরই নিখোঁজদের সন্ধানে পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এছাড়া দেশে শতাধিক লোক নিখোঁজ আছে। এর মধ্যে ১০ জনের ছবি ও নাম পরিচয় প্রকাশ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধারণা করা হচ্ছে, এই দশ জন জঙ্গি সংগঠন আইএসে যোগ দিয়েছে।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।