এবারও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না: লোকসান দিতে চায় না পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো!

bf429c59eccএবারও পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়গুলোয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে  না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ইস্যুতে একমত হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করছে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য  থাকবে না। তাই তারা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় আগ্রহী নয়। এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ উপার্জন করত।  সমন্বিত পরীক্ষা হলে সে আয় থেকে বঞ্চিত হবে। এ কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) এইচএইসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৮ লাখ ৯৯ হাজার শিক্ষার্থী এখন অংশ নেবে উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষায়।

এদিকে, ভর্তি যুদ্ধে অংশ নেওয়া গতবছরের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যখন ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি, তখন  একদিন পরপর একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছুটতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ভর্তি ফরম কিনতেও অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া পরীক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতেও প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি মেডিক্যাল কলেজগুলোর মতো  একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতো, তাহলে ভর্তিচ্ছুরা এত ভোগান্তিতে পড়তেন না।

প্রসঙ্গত, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে কয়েক বছর আগে থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। এ নিয়ে কয়েকদফা বৈঠকও হয়। কিন্তু ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি।

২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে এক বৈঠকে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই বৈঠকে চার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি কমিটি, পাঁচটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি এবং চারটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটিসহ মোট তিনটি কমিটি গঠন করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এছাড়া একটি কেন্দ্রীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।

বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছর তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলেও বলা হয়েছিল, পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০১৬ সাল থেকে শুরু হতে পারে। কিন্তু এবারও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় রাজি হয়নি। এদিকে, গত জুলাই মাসে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে অনীহা কেন—এমন প্রশ্নে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি’র একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষা থেকে ভর্তি ফরম বাবদ মোটা অংকের টাকা আয় করে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে তারা এই অর্থ উপার্জন থেকে বঞ্চিত হবে। তারা এই লোকসান মানতে রাজি নয়। তাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় তাদের অনীহা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফরম বাবদ আয় করেছিল প্রায় ৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একই শিক্ষাবর্ষে আয় করেছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা। প্রতিবছর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভর্তি পরীক্ষার ফরম থেকে এমন মোটা অংকের টাকা আয় করে।

তবে, সূত্রগুলো এও বলছে, শুধু লোকসানের কথায় যে তারা ভাবছেন, তাও নয়। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো  নিজেদের স্বতন্ত্র মানও বজায় রাখতে চায়।

এদিকে, বহুদিন ধরে আলোচনা হলেও গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ায় হতাশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অন্যদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করার পক্ষে বহুদিন ধরেই মত দিয়ে আসছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিও এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে আসছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনীর কারণেই আটকে আছে।

ইউজিসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান শনিবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে ভালো হতো। তার চেষ্টাও করা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। এটা একদমই দুরাশার নয়, তবে কিছুটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ দেশে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সবাইকে একসঙ্গে একমত করে এনে সমন্বিত পরীক্ষা নিতে গেলে অনেক পরিকল্পনার দরকার রয়েছে। এখনও পরিপূর্ণভাবে সেটা করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, এই পরীক্ষা নিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই একমত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি না চায়, তাহলে মঞ্জুরি কমিশন চাপিয়ে দিতে পারে না।

এদিকে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলে আসছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা গ্রহণ না করে নিজস্ব নিয়মেই পরীক্ষা নেয়, তাহলে করার কিছু নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উদ্যোগ নিলে আমরা সব ধরনের সমর্থন দেব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আমরা তাদের জোর করতে পারি না। কোনও সিদ্ধান্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতেও পারি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরিফিন সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখন অনলাইনের সুবিধা বেড়ে গিয়েছে, ফলে ভর্তিচ্ছুরা তার নিজ এলাকাতে বসেই ভর্তি ফরম পূরণ করতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি তুলনামূলক কম হবে। তিনি আরও বলেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে অনেকেই অনিচ্ছুক। এর কারণ, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ভর্তি-পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের যাচাই করে ভর্তি করতে চায়।

কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলেও ভর্তিচ্ছুদের কেন্দ্রে পৌঁছাতে হয়, একাধারে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয়। এখানেও তো শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. আ আ ম স আরিফিন সিদ্দিকী বলেন, এখন অনলাইনের সুবিধা সবখানে পৌঁছে গেছে। ফলে আমরা পরিকল্পনা করেছি পরীক্ষার্থী ঘরে বসেই যেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভর্তি ফরম থেকে টাকা আয় হয় ঠিকই কিন্তু ব্যয় হয় তার চেয়েও বেশি। তিনি আরও বলেন, যেমন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গতবছর যে টাকা ফরম বাবদ আয় হয়েছিল, তার চেয়ে ৭ লাখ টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে। এখান থেকে লাভ করার কোনও সুযোগ নেই। তবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলে আসলেই শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমে যাবে।

জবি উপাচার্য আরও বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার নেওয়ার বিষয়ে একমত না হলেও রাজধানীতে দুটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকবছর ধরে একই দিন পরীক্ষা নিয়ে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকালে পরীক্ষা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকেলে। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি আমরা অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছি।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।