আমি লাঞ্ছিত এক সংখ্যালঘু বলছি……….

attackএস কে দাসঃ সেই সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পরিক্রমায় তোমাদের এই ভূখন্ডে আমার জন্ম।  সেই জন্মটাই আজ আজন্মপাপ আর অভিশপ্ত । আমার এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত আর গ্লানি আমি যুগ থেকে যুগে বয়ে চলছি। অনেক ঝড় তুফানের পরেও নাড়ির টানের ভালবাসায় এই মাটির অন্ধমোহ তবু ছাড়তে পারি নি। বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি নি আমার অভিশপ্ত জন্মের রক্তের ঋণের সাথে ।

সাতচল্লিশের দাঙ্গায় ওরা ধর্মের দোহায় দিয়ে আমার পূর্ব পুরুষদের অনেককে পিটিয়ে মেরেছিল । বাধ্য করেছিল জন্মভূমির দাবি ছেড়ে আজানা মরুভূমির যাযাবর বাসিন্ধা হতে । সেইবার সবকিছু হারিয়েও আমি দেখেছি আমার পরিবার সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের আলিঙ্গন ত্যাগ করেছিল শুধু জন্মভূমির প্রতি ভালবাসার দায়বদ্ধতার তাড়নায় ।

আমার এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, বাংলাদেশটা কার? এই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো মহান দার্শনিককে। এদেশের জন্য শহীদ হয়েছেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদা প্রসাদ সাহা, নূতন চন্দ্র সিংহ এর মতো অনেক মহান ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার এতো বছর পর এখন কি চিন্তা করতে হবে তাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়ের  না না না মালাউন ছিলেন কিনা! এদেশের অসংখ্য বধ্যভূমিতে হিন্দু-মুসলমানের রক্ত কি একই সঙ্গে প্রবাহিত হয়নি? একই জন্মভূমির মাটিতে কি তাঁদের শবদেহ পড়ে থাকেনি? হিন্দু ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা কি একই সঙ্গে একই ঘাতকের হাতে প্রাণ দেননি? পাকিস্তানি পিশাচরা যখন ঘরে ঘরে ঢুকে আমাদের হত্যা করেছে, তখন তো তারা মুসলিমকে রেহাই দিয়ে হিন্দুদের হত্যা করেনি; তারা বাঙালি মাত্রকেই হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, নির্যাতন করেছে।  তাহলে এতো বছর পর আমাদের মধ্যে এই বিভেদের বিষাক্ত কাঁটাগাছ কোথা থেকে গজাচ্ছে?

সংবিধান ২ এর ‘ক’ তে স্পষ্ট উল্লেখ আছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্টধর্ম ইসলাম। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ অনান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবেন।

কিন্তু রাষ্ট্রের একজন মন্ত্রী যখন একটি ধর্ম বা সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে কটূক্তি করে তখন তার শপথ বাক্য ভঙ্গ হয়। মন্ত্রী যে অপরাধ করেছেন তাতে তার আর মন্ত্রী থাকার অধিকার থাকে না।”

অথচ তিনি চারদিন পর এসে বললেন তিনি এসব কিছু বলেননি বা বলতে পারেন না। এটা যে তার বুলি ছোড়া তা সাধারন মানুষ বোঝে।

এই যে সেই দিন পুরানো শকুন গুলো আবারো নাসিরনগর সংখ্যালঘুদের  বাড়িতে আগুন দিল,লুটপাত করল,বেদম প্রহার করল । ভেঙ্গে দিল তোমার স্বাদের প্রতিমা,জ্বালিয়ে দিল মন্দির । কই তোমার সাহায্যে তো কোন দরদী বন্ধু এগিয়ে আসে নাই ? দুই একটা সংবাদের শিরোনামে তোমার অসহায়ত্ত্ব নিয়ে ওরা রাজনীতি করেছে মাত্র হয়ত কিছু দায়ছাড়া সহানুভূতি তোমার কপালে জুটেছে । কিন্তু ওরা কি খবর নিয়েছে কিভাবে আজকে চারটা দিন তুমি তোমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খোলা আকাশে রাত্রি যাপন করতেছ ? কিভাবে এত গুলো অসহায় মুখের খাবার যোগান দিচ্ছ? কতটা নিরাপত্তাহীনতাই, ভয় আর আতংকে তুমি সময় কাটাচ্ছো কেউ কি খবর নিয়েছে?

আমি একজন সংখ্যালঘু হিসাবে বলছি আমি বিশ্বাস করি সারা পৃথিবীতে কোন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য ধর্মের উপর আঘাত হানে না। হানতে পারে না। কারন তাদের সেই মানসিকতা কখনও তৈরি হয় না বা তৈরি হতে পারে না। এমনকি তাদের ধর্মের উপর হাজারো আঘাত হানলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক সেগুলোকে নিরবে সহ্য করে। এটা তাদের কোন দূর্বলতা নয়। এটা তাদের সভ্যতা।

কিন্তু একটা বিষয় আমাকে ভাবায়, সেটা হলো আমাদের দেশের অনেক মানুষের মনের ভিতর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের একটা দানব নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে আছে। যে কোনো সুযোগে বোতল খুলে সেই দৈত্য বেরিয়ে আসে। যদি মনের ভিতরে বিদ্বেষের রাক্ষস ঘুমিয়ে না থাকতো, তাহলে তো গুজবের খোঁচায় তার জেগে ওঠার কথা নয়।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।