অবসরেও ভোগান্তি শিক্ষকদের

ntrcডেস্ক রিপোর্ট : মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় শিক্ষকদের। ব্রতী হয়ে জ্ঞানের আলো জ্বালান তারা। তাদের আলোকিত শিষ্যরা হয় রাষ্ট্রনায়কও। যে মানুষগুলো জীবনের শক্তিসামর্থ্যরে সময়টা ব্যয় করেন অন্যের ঘরে প্রদীপ জ্বেলে, বার্ধক্যে এসে তাদেরই হতে হয় অন্যের কৃপার পাত্র। এমন করুণ পরিণতি বরণ করতে হয় অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের।

শিক্ষকতা থেকে অবসরগ্রহণের পর বার্ধক্যে যোগ হয় নানা রকম অসুস্থতা। কেউ পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে সুচিকিৎসার অভাবে পঙ্গুত্ববরণ করেন। কেউ চলে যান না ফেরার দেশে। যথাসময়ে পান না কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার অর্থ। ফলে জীবনের শেষপ্রাপ্তির অর্থ ভোগ করার ভাগ্য হয় না অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর। অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার অর্থ হাতে পেতে ৪ থেকে ৫ বছর অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়।

বেসরকারি একটি কলেজের শিক্ষক মো. ইউনুস বৃহস্পতিবার আসেন বেসরকারি শিা প্রতিষ্ঠান শিক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে। তিনি জানান, ২০১৩ সালে অবসরগ্রহণ করেছেন। রাজধানীর পলাশী মোড়ে বেনবেইস ভবনে এসেছেন তার অবসর সুবিধার অর্থপ্রাপ্তির খোঁজ নিতে। বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাকে ২০১৭ সালে এসে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দিলে অশ্র“সজল চোখে ভেঙে পড়েন ৭০ বছরেরও বেশি বয়সী এই শিক্ষক। তার বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। ঢাকায় রাত্রিযাপনেরও সুযোগ নেই। সন্ধ্যায় রওনা হবেন বাড়ির পথে। পারিবারিক অসচ্ছতার কথা জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। হাঁস-মুরগি পালন আর সামান্য কৃষি জমি চাষ করেন। শস্য বিক্রির অর্থে চালান তিন সন্তানসহ পাঁচ সদস্যের সংসার।

কক্সবাজার থেকে মাদ্রাসা শিক্ষক মো. হাবিবুল্লাহ এসেছেন কল্যাণ ট্রাস্টে তার টাকা কবে পাবেন জানতে। তিনি জানান, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অবসরগ্রহণ করেছেন। আবেদন জমা দিয়েছেন একই বছরের মার্চ মাসে। ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের কাছে জেনেছেন কমপক্ষে চার বছর লাগবে কল্যাণ ফান্ডের টাকা পেতে। হতাশ হয়ে এই শিক্ষক বলেন, ‘যাদের পড়িয়েছি তারাই আজ অনেক বড়-বড় পদে চাকরি করছে। আমরা তাদের কাছে গিয়ে ধরনা দিচ্ছি জীবনের শেষ প্রাপ্তির আশায়।’

শিক্ষকদের এই দুর্ভোগ লাঘব করতে সরকারকে আন্তরিক হওয়ার দাবি জানান হাবিবুল্লাহ।

এই শিক্ষকদের মতোই প্রতিদিন বেসরকারি শিক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং বেসরকারি শিা প্রতিষ্ঠান শিক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের কার্যালয় শত-শত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী আসেন। কোনো ফল না পেয়ে চরম হতাশ হয়ে ফিরে যান তারা। দুটি কার্যালয়ে যে পরিমাণ আবেদন জমা পড়ে তার ৪-৫ শতাংশ আবেদনও নিষ্পত্তি করা হয় না প্রয়োজনীয় অর্থ সংকুলান না থাকায়।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি শিা প্রতিষ্ঠান শিক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদি জানান, বর্তমানে প্রায় ৪৩ হাজার আবেদন জমা পড়েছে অবসরোত্তর সুবিধার অর্থপ্রাপ্তির জন্য। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে বোর্ডের প্রয়োজন প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, প্রতিমাসে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের কাছ থেকে কেটে নেওয়া ৪ শতাংশ অর্থ থেকে প্রায় ৩৪ কোটি টাকার জোগান হয়। অথচ মাসে প্রয়োজন প্রায় ৭০ কোটি টাকা। ফলে প্রতিমাসে ঘাটতি থাকে ৩৬ কোটি টাকা। আগে জমা নেওয়া আবেদন আগে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারি ও ফেব্র“য়ারি মাসে যারা আবেদন করেছেন তাদের আবেদন নিষ্পত্তি করা গেছে। এর পরের মাসের আবেদনগুলো নিয়ে দাপ্তরিক কাজ চলছে।

অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদি জানান, বিলম্বিত প্রক্রিয়ার কারণে শিক্ষকদের অবসর সুবিধা পেতে সময় লাগে ৫ বছরের অধিক। তবে হজ গমনেচ্ছু এবং ক্যানসারসহ কিছু দুরারোগ্য ব্যাধির জন্য মানবিক কারণে সিরিয়াল ব্রেক করে আবেদন নিষ্পত্তির মাধ্যমে অর্থ প্রদান করা হয়।

বেসরকারি শিক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্য মো. শাহজাহান আলম সাজু জানান, প্রায় ৩০ হাজার আবেদন জমা আছে ট্রাস্টে। এজন্য প্রয়োজন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। প্রতিদিনই বাড়ছে আবেদনের সংখ্যা। প্রয়োজনীয় অর্থ সংকুলান না হওয়ায় প্রায় ৪ বছর লেগে যায় শিক্ষকদের আবেদন নিষ্পত্তি করতে।

তিনি জানান, সর্বশেষ বাজেটে বেসরকারি শিক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধা পাওয়ারেে ত্র ভোগান্তি কমাতে সরকার এ খাতে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে অবসর সুবিধার জন্য ৫০০ কোটি টাকা সিডমানি ও ১০০ কোটি টাকা থোক হিসেবে। আর কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য থোক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৫০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া এই খাতে শিক-কর্মচারীদের কাছ থেকে কেটে নেওয়া মাসিক টাকার পরিমাণও বাড়ানো হচ্ছে বলে জানান এই ট্রাস্টের সদস্য সচিব। নতুন পেেদপর ফলে আবেদন জমাকারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধার চেক দেওয়ার পথ সুগম হবে।

ট্রাস্ট এবং বোর্ডের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯০ সালে গঠন করা হয় ট্রাস্ট। ৬ মাস চালুর পর ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে এই ফান্ডের অর্থ কেটে নেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ছিল স্থবির। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকার ফের কার্যক্রম চালু করে। শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্ট ও সুবিধা বোর্ডের জন্য বার্ষিক ৫ টাকা হারে শিক্ষার্থীদের যে চাঁদা আদায় হতো সেটাও বন্ধ করা হয় ২০০২ সালে। এত দিনের অর্থ জোগানোর পথ বন্ধ থাকায় ট্রাস্টে এখন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষকদের সর্বশেষ বেতনক্রম অনুযায়ী কল্যাণ ও অবসর সুবিধা প্রদান করা হলেও সেই হারে বাড়ানো হয়নি ফান্ডে জমা চাঁদার পরিমাণ। শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর পর এখন নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তাদের কাছ থেকেও আদায় করা চাঁদার হার বাড়ানোর। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও বার্ষিক কিছু অর্থ শিক্ষকদের অবসরোত্তর ফান্ডে জমা নেওয়া হবে। দৈনিক আমাদের সময়

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।