অনভিজ্ঞদের দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা

এস কে দাস : শেরেবাংলা একে ফজলুল হক প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করেন ও জেলা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে আনেন। তখন থেকে প্রবীণ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হতো।

খালেদা জিয়া সরকার গঠনের পর থেকে শুরু হয় শতকরা ৩৫ ভাগ বহিরাগতদের প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রদান। এ প্রক্রিয়া এখনও চলছে। পদোন্নতির মাধ্যমে ৬৫ ভাগ প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘ ৮ বছর ধরে বন্ধ।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি বন্ধ থাকায় বহু শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি না পাওয়ার ক্ষোভ ও বেদনা নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

শিক্ষকদের নানা ফাঁকফোকর দেখিয়ে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। উচ্চ আদালত শিক্ষকদের পক্ষে রায় দেয়ার পরও চলছে সময়ক্ষেপণ ও নানা টালবাহানা।

কিছু ব্যক্তির হীন স্বার্থে পরিবর্তন করা হয়েছে বদলি নীতিমালা। সারা দেশের বদলির দায়িত্ব যেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর। প্রথমে পৌরসভার মধ্যে বদলি বন্ধ রাখলেও পরে তা তুলে নিয়ে আরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে সাধারন শিক্ষকরা । কারন হিসাবে দেখা যায় পৌরসভার মধ্যে যাদের নিজস্ব ঠিকানা তারা আর পৌরসভায় ঢুকতে পারছে না। পৌরসভার বাইরে থেকে আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং সিনিয়ারিটির কারনে পৌরসভার বাসিন্দারা পৌরসভার মধ্যে বদলী হতে পারছে না।

এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ড. মজিদ খান শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন। মন্ত্রী মহোদয় কাউকে শুধু ‘yes’ লিখে দিলেই শিক্ষক হিসেবে তার চাকরি হয়ে যেত।

পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম বদলিসহ সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন।এসব কর্মকাণ্ড অতীতের মতো বর্তমানেও একশ্রেণীর লোক, বিশেষ করে সমিতির কিছু নেতা মহৎ কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

বর্তমানে বদলির পেছনে দৌড়ানো ভুক্তভোগীরা ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। মন্ত্রণালয় তথা সমিতির নেতাদের বদলির চাপে হারিয়ে যেতে বসেছে সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি। সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি নিয়ে মন্ত্রণালয় তথা সংশ্লিষ্টদের যেন মাথাব্যথা নেই।

এ পদোন্নতি নিয়ে কোনো আইনগত জটিলতা থাকলে প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতাদের চাপে  আপাতত সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়ার অভিমত দেয়া হয়েছে।

বরং সম্প্রতি ৮৯৮ জন নন-ক্যাডারকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হয়তো তাদের নন-ক্যাডার হিসেবে অন্য কোনো পেশায় নিয়োগ দেয়া সম্ভব না হওয়ায় এ পেশায় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এ পেশায় শিক্ষকতার মানসিকতা নিয়ে তারা কতটুকু দায়িত্ব পালন করবেন জানি না। তবে তাদের অন্য চাকরির সুযোগ না থাকায় শিক্ষকতাকে চাকরি হিসেবে গ্রহণ করবেন। যেহেতু তাদের সবাই প্রশিক্ষণবিহীন, সেহেতু জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী তাদের বেতন হওয়ার কথা ১১,৩০০ টাকা। তাদের বেশিরভাগের বয়স ৩০-এর নিচে। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে অপেক্ষা করে বসে আছেন পদোন্নতির অপেক্ষায়। এ অপেক্ষা শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। নিজের ছাত্রের সমতুল্যদের অধীনে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করায় যে দুঃসহ যন্ত্রণা, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কে উপলব্ধি করবেন?

শিশুকাল থেকে জঙ্গি কার্যক্রম অংকুরেই নির্মূল করার প্রত্যয় নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কার্যক্রম। সাধারণত নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রমের লক্ষ্য সৎ, বিনয়ী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, যার যার ধর্ম, মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা, বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করা ইত্যাদি গুণাবলি অর্জন করানো। যাতে আজকের শিশু বড় হয়ে আদর্শ মানুষ হতে পারে।

ইংরেজ আমলে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার জন্য কাচারি/বাংলা ঘরে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হতো।তখন বাংলা ভাষা পড়ানোর জন্য পণ্ডিত মহাশয় এবং আরবি ভাষা যেমন- কায়দা, আমপারা, কোরআন শরিফ, দোয়া ও হাদিস শিক্ষা দেয়ার জন্য মুন্সী নিয়োগ দেয়া হতো। ক্রমান্বয়ে শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করার পর জমিদার বা বিত্তশালীরা বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া শুরু করেন।

বর্তমানে শুধু প্রধান শিক্ষক নয়, প্রাথমিকে কর্মকর্তার সব পদে অনভিজ্ঞ লোকদের নিয়োগ দেয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন শিক্ষক হিসেবে অনভিজ্ঞরা। এতে প্রাথমিক শিক্ষার কাক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না। সব পেশায় ক্যাডার আছে অথচ প্রাথমিক শিক্ষায় কোনো ক্যাডার নেই। এতবড় একটি জনগোষ্ঠী মুখ থুবড়ে পড়ছে নিজস্ব ক্যাডারের অভাবে। সবাই যেন নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। হতভাগা প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে ভাবনা নেই কারও। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সব অনভিজ্ঞ লোকদের নিয়োগ বন্ধ করে স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার গঠন করা জরুরি বলে মনে করেন প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ্র।  পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায় থেকে সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হলে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জিত হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সফলভাবে চললে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। শিক্ষার ভিত সুদৃঢ় হবে। নৈতিক শিক্ষার পরিপন্থী কার্যক্রম বন্ধ হবে। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সবার মাঝে ভাবনার উদয় হোক, প্রাথমিকের শিক্ষক সংগঠনগুলোর ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি দূর হোক, এটাই প্রত্যাশা।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।