নুসরাত অদিতি : ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে জোরেসোরে। জাতীয় দলগুলো এখনো প্রার্থী তালিকা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করেনি। রাজনৈতিক প্রচার শুরু হয়ে গেছে ভাল মতই। দশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিআই জোট সরকার আর ক্ষমতায় থাকা ভারতের জনতা পার্টি দু’টিই প্রধান প্রতিপক্ষ। আবার পশ্চিম বঙ্গের মত অনেক রাজ্যেই আঞ্চলিক দল গুলোই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
ঐ রাজ্যে নির্বাচনে কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে এবং নির্বাচনী লড়াইটাইবা কেমন হচ্ছে এর ওপর পর্যবেক্ষণ করে অমিতাভ ভট্টাশালী একটা বিশেষ প্রতিবেদন করেছেন।
নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে পশ্চিম বঙ্গে বুধবার থেকে ভোট গ্রহণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মনোনয়ন জমা দেয়া আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু তার আগে থেকেই নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণার দিনই প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে কাজে নেমে পড়েছে পশ্চিম বঙ্গের দুই প্রধান প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস আর বামফ্রন্ট। পরীক্ষার জন্য মাইক বাজিয়ে জনসভা করা নিষেধ তাই ছোট ছোট মিছিল আর দেয়াল লিখনের মাধ্যমে চলছে প্রচার।
কি কি বিষয় উঠে আসছে প্রচারে জানতে চাওয়া হয়েছিল রাজ্য বিধান সভায় তৃণমূল কংগ্রেসের এর মূখ্য সরকারি সচেতক ও প্রবীন নেতা শোভনদ্বীপ চ্যাটার্জির কাছে। তিনি এ বিষয়ে বলেন, মূলত যারা এতদিন সরকার চালাল সেকেন্ড ইউপিএ তারা এমন এমন সিদ্ধাšত্ম নিয়েছে বিদেশি শক্তির চাপে পরে, যেগুলো মানুষের স্বার্থ বিরোধী। যেগুলো স্বভাবতই দেখা যাচ্ছে যে মানুষকে ক্ষতিগ্র¯ত্ম করছে। দুই হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার যেহেতু তার ‘রেট অব গ্রোথ’ এর পরিমাণটা এতই কম যে কৃষিতে মাইনাস, জিডিপি বৃদ্ধি সেও তিন চারের বেশি উঠছে না। সে কারণে গ্রোথ না হলে তো জিনিস পত্রের দাম বাড়বেই। গ্রোথ এর ব্যাপার রয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছে তো এমন ব্যবস্থা গ্রহণের রা¯ত্মা বের করতে হবে দুর্নীতি থাকবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এ কাজগুলো করতে পারছে না সেটাই মানুষকে বোঝাচ্ছি আমরা।
বামফ্রন্ট এর প্রধান শরীক সিপিআইএম এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সেলিম বলছিলেন রাজনৈতিক ইস্যুগুলোই তাদের প্রচার অভিযানে গুরুত্ব পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার যে পথে এবং যে নীতিতে দেশটিকে চালিয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্য¯ত্ম হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির মধ্যে বিপর্যয় এসেছে, কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে, শিল্প উৎপাদন কমে গিয়েছে ক্রমাগত, তার ওপর দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছে। আমাদের দেশের একটা বড় অংশের মন্ত্রী, তারা হয় জেলে আছে না হয় বেলে আছে। মূল্য বৃদ্ধির রেকর্ড গত পাঁচ বছরে যা বেড়েছে আমাদের দেশে কখনো জিনিসের দাম এত বাড়েনি যা সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে। আর মানুষ বুঝতে পেরেছে যে এই সরকার থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল।
জাতীয় রাজনীতিতে দুই প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস আর বিজেপি যে ইস্যুগুলো নিয়ে দেশ জুড়ে প্রচার করছে সেই গুড গভারনেস বা সুশাসন যার মধ্যে রয়েছে উন্নয়ন প্রচেষ্টা, মূল্যবৃদ্ধি রোধ, দুর্নীতি প্রভৃতি আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।
বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর প্রচার চলছে টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও সংবাদপত্রে। কংগ্রেসের নির্বাচনের কা-ারি রাহুল গান্ধীও প্রচার করছেন তাদের সরকারের গত দশ বছরের কাজ কর্মের ক্ষতিয়ান। পশ্চিম বঙ্গেও কংগ্রেস এবং বিজেপির প্রচারের মূল ইস্যু এগুলোই। যদিও এ রাজ্যের দুই প্রতিপক্ষ দল অনেকটাই কম শক্তিশালী। কিন্তু বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন বিজেপি তাদের শক্তি বৃদ্ধির ইঙ্গিত পেয়েছে গত কয়েক নির্বাচনে তাই ভোটের প্রচারে যথেষ্ট জোর দিচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে বিজেপি যে প্রচার শুরু করেছে, যে ঝড় তোলার চেষ্টা করছে তাতে পশ্চিম বঙ্গের বিজেপিকে একটা নম্বর দিতেই হবে এবং তাদেরকে চতুর্মূখী লড়াইয়ে রাখতেই হবে। যদিও আমার খুব সন্দেহ আছে যে এবারও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোন আসন পাবে কিনা। তবুও তারা হয়ত কোন কোন আসনে কারও কারও ভোট কেটে নেবে। এখনো পর্যšত্ম বিষয়টা খুব পরিষ্কার নয় যে কোথায় বিজেপি কার ভোট কাটবে। তাহলেও তারা এবার একটা পার্সেন্টিজ অব ভোট পাবে।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তার দলের নির্বাচনী কৌশল। তিনি এ বিষয়ে বলেন- অমরেশ, সিপি এবং তৃণমূল তিন পক্ষকেই সমান আক্রমণের নীতি নিয়ে এবার আমরা নির্বাচনে নামবো। আর যেখানে যার অ¯িত্মত্ব বেশি কম আছে সেই অনুপাতে আক্রমণের ধারা কিছুটা চেঞ্জ হবে।
সিনহার কাছে পাল্টা প্রশ্ন করা হয় যে নরেন্দ্র মোদীর ওপর ২০০২ এর গুজরাটের দাঙ্গায় মদত দেয়ার অভিযোগ রয়েছে সেটা কিভাবে সামলাবেন তারা। তিনি এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, আগে বিজেপির প্রতি বা মোদীর প্রতি মুসলমানদের একটা অনিহা ছিল, সেটা আগে। এখন মুসলমানরাও তো ভারত বর্ষের নাগরিক, তারাও তো চোখ মেলে দেখতে পারছে। ১২ বছর আগে গুজরাটে যে ঘটনা ঘটেছে সেটাও একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। আর তারাও এটা খোঁজ রাখছে যে গুজরাটে মুসলমানের শিক্ষার হার কত, সেখানে ব্যবসার হার কত, মুসলমানের চাকরির হার কত সে খবরগুলো এখন মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা রাখছে।
তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শোভনদেব চ্যাটার্জি অবশ্য বলছেন, গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ তারা কৌশলগত কারণেই এ রাজ্যে বেশি প্রচারে আনছেন না। বিজেপিকে নিয়ে আলোচনা করছে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে কেন? কংগ্রেসের ভোট যেখানে সিপিএম এর ভোটও সেখানে। বিজেপিকে মূল প্রাসঙ্গিক করে দেয়াটা এটা কৌশলগত কারণে আমার মনে হয় না খুব বেশি কিছু বলা দরকার।
তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে না চাইলেও প্রায় এক তৃতীয়াংশ মুসলমান তারা কিন্তু যথেষ্টই চিšিত্মত নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে তাদের কি হবে সেটা নিয়ে।
বিজেপি নেতা নরেন সিনহার দাবি মানতে নারাজ মুসলমানরা। বলছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক মোহাম্মদ সোলায়মান খোরশেদ। তিনি বলেন, মুসলিমদের মধ্যে একটা হতাশা দেখা যাচ্ছে। তারা কিন্তু কিছুতেই নরেন্দ্র মোদীকে মাফ করতে চায় না। যেহেতু ২০০২ সালে গুজরাটে যে দাঙ্গা হয়েছে সেটা নিয়ে তারা আতঙ্কিত।
পশ্চিমবঙ্গের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে মুসলমানরা বঞ্চিত হয়ে চলেছেন দশকের পর দশক সেটাও এবারের ভোটের আগে ভাবাচ্ছে তাদের। অধ্যাপক খুরশিদ বলেন, বামপন্থিদের কাছে মুসলমানরাও অনেক আশা করেছিল যে তাদের জন্য কিছু করা হবে কিন্তু দেখা গেল যে কিছুতেই তাদের সংখ্যা সরকারি চাকরিতে বাড়তে পারেনি, ওই ২ শতাংশের মতই থেকে গেছে। মুসলমানরা কিছু পায়নি বামপন্থিদের কাছ থেকে তাই তারা একমত হয় ২০০৯ সালে এবং ২০১১ সালে। তৃণমূল ও কংগ্রেস যখন যৌথভাবে ভোটে দাঁড়িয়েছিল তখন তারা তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনে ছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি যদিও তিনি বার বার বলছেন যে তিনি মুসলমানদের কাছে যেটা কথা দিয়েছিলেন তার ৯০ শতাংশ তিনি পূরণ করেছেন। কিন্তু বা¯ত্মবতা হল যে মুসলমানদের চাকরির ক্ষেত্রেও কিন্তু সংখ্যা বাড়েনি এবং তাদের কাজের উন্নয়নের জন্যও কিন্তু কিছু করা হয়নি।
বলিউড সুপার স্টার শাহরুখ খানকে দিয়ে ‘নতুন বাংলা প্রগতির বাংলা’ এই শ্লোগান দিয়ে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন করা হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বিজ্ঞাপটিতে যে পরিবর্তিত বাংলা, নতুন বাংলা গড়ে উঠছে বলে দাবি করা হচ্ছে আসলে সেই দাবি কতটা বা¯ত্মব তৃণমূল কংগ্রেসকে দিতে হবে সেই পরীক্ষা। যেমন জাতীয় ¯ত্মরে গত দশ বছরের শাসনামলের হিসাব দিতে হচ্ছে কংগ্রেসকে বা বিজেপি চেষ্টা করছে গুজরাটের উন্নয়নের ছবি তুলে ধরতে।
এ বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়েছিল রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যারয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায় চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি এ বিষয়ে বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসেরও ক্ষমতায় থাকার আড়াই বছর কেটে গেছে। আর সেই জায়গায় দাড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবেই সুশাসনের প্রশ্নটা এখানে একটা বড় ইস্যু থাকবে। দুর্নীতির প্রসঙ্গ এসেছে, কিন্তু তার চেয়ে সুশাসনটা হয়তো জাতীয় এবং রাজ্য¯ত্মরে উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিআইএম’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সেলিম বলছিলেন, কিভাবে তারা ক্ষমতাসীন দলের শাসনামলের তিন বছরের প্রসঙ্গ তুলে ধরছেন। তিনি বলেন, আগে আমরা এই দুর্নীতির প্রশ্ন সর্বক্ষেত্রে দেখতাম এবং সে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন হোক বা অন্য যেকোন দলের নেতৃত্বাধীন হোক, দলগুলোকে দেখতাম। পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের বড় ঘোটালা বা স্ক্যাম এর কথা আমরা শুনতাম না। কংগ্রেস এবং তৃণমূলের যে জোট সরকার তৈরি হল তারপরে আমরা দেখলাম শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে একই ভাবে চিট ফান্ড, শুধু সারদা নয় অসংখ্য চিট ফান্ড কনজিউম স্কিমের মাধ্যমে তারা গরিব মানুষকে সর্বস্বাšত্ম করেছে। রাজনৈতিক লাভ তৃণমূল কংগ্রেস যেমন তুলেছে তেমন অর্থনৈতিক লাভ এই চিট ফান্ড গুলো তুলেছে।
প্রদেশ কংগ্রেস বলছে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে বেআইনি আমানত সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান বা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি প্রধানত সেগুলো নিয়েই তারা প্রচারে নামছেন।
প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র ওম প্রকাশ মিশ্রার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের দলের বিরুদ্ধেই তো জাতীয় ¯ত্মরে বড় বড় কেলেঙ্কারির অভিযোগ। তারা কিভাবে অন্য দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার চালাবেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার কোন ব্যাপারেই পিছপা হয়নি অনেকেই জেনে গেছেন অনেকটাই বিচারাধীন রয়েছে। কংগ্রেসের কোন নেতার গায়ে এখন পর্যšত্ম দুর্নীতির তকমা এটে দিয়ে কোর্ট কিন্তু কোন রায় ঘোষণা করেনি এটা মনে রাখতে হবে।
তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য বলছে বিরোধীরা যতই প্রচার করুক চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িত সন্দেহে নিজের দলের সংসদ সদস্যদের পর্যšত্ম গ্রেপ্তার করাতে পিছপা হননি দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জি। বলছিলেন শোভনদেব চ্যাটার্জি। তিনি আরও বলেন, এগুলো সবকটার গ্রোথ কিন্তু বামপন্থিদের আমলে। আমাদের আমলে এরা অনেক বেশি সতর্ক হয়েছে যে কিছু করলে আমাদের জেল হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সমীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে হিসাব কষে প্রচারের ইস্যু ও প্রতিপক্ষ দলকে টেক্কা দেয়ার হিসাব রচনা করেছেন। আর এখন সেই কৌশল কাজে লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। ১৬মে ভোট গণনার দিন বোঝা যাবে যে ভোটাররা আসলে কি সিদ্ধাšত্ম নিলেন। কাকে সরকার গড়তে পাঠালেন আগামী পাঁচ বছরের জন্য। বিবিসি
by