শিশুদের নিয়ে এই তামাশা কি সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক

২০০৯ সাল মহাজোট সরকার গঠন করে জানুয়ারি মাসে। সেই বছরের শেষে এসে ৫ম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ২০০৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়। এত অল্প সময়ের ভেতর খুব একটা ভাবনাচিন্তা করে পরীক্ষাটি চালু করা হয়েছিল বলে মনে হয় না। তবে শোনা যায় যে, পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল এবং তারা পুনরায় ক্ষমতায় এলে এরকম ব্যবস্থা চালু করবে এরকম ব্যাপার ছিল। এত কম বয়সের ছেলেমেয়েদের ওপর পাবলিক পরীক্ষা চাপানোর নজির আর কোথাও পাওয়া যাবে না।

বৃত্তি পরীক্ষা যেটি নেয়া হতো সেটিতে সীমিত শিক্ষার্থীরা অংশ নিত যা ঐচ্ছিক এবং পরীক্ষার বিষয়ও কম। এ ধরনের নির্যাতনমূলক পরীক্ষায় ছাত্রদের কোচিংয়ের আশ্রয় নেয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। পিএসসির পর পর অষ্টম শ্রেণি শেষে জেএসসি চালু করা হয়। আর এসএসসি এবং এইচএসসি তো আগে থেকেই ছিল। এর ফলে বাংলাদেশ শিক্ষা সংক্রান্ত কোচিং ব্যবসার চারণভূমিতে পরিণত হয়। এখন এই কোচিং ব্যবসায় অর্থ সঞ্চালনের পরিমাণ নাকি বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা। সেই সঙ্গে সহায়ক বইয়ের ব্যবসাও জমজমাট। এ বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে যে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হবে, তার একটি সহায়ক বইয়ের সেট বিক্রি করে একটি প্রতিষ্ঠান ১০০ কোটি টাকা অর্জন করেছে বলে খবর বেরিয়েছে।

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের জন্য কিছুকিছু আন্দোলন গড়ে উঠেছে। কেন এ পরীক্ষা বাতিল করা হবে না কারণ জানতে চেয়ে মাননীয় হাইকোর্ট ডিভিশন থেকে রুল জারি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গত কয়েক দিন আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্ববান কর্মকর্তা জানালেন যে, এই প্রাথমিক পরীক্ষা বাতিল করা হলো এবং তা এ বছর থেকে কার্যকর হবে।

এখানে উল্লেখ্য, দেশের শিক্ষাবিদ এবং বৃদ্ধিজীবীরা বারবার দাবি জানাচ্ছিলেন যে, কিশোরদের পরীক্ষার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা হোক। অতএব তারা এ সংবাদকে সাধুবাদ জানালেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত এক টেলিভিশন আলোচনায় সরকারকে এই সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দন জানালেন। এ কথাও তখন শোনা গেল যে, আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য পরবর্তী মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে এবং সেই সঙ্গে বৃত্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা হবে।

এখানে উল্লেখ্য, পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল যে, প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের সম্মতি নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ কথায় আমরা সবাই আশ্বস্ত হলাম। গত ২৭ জুন মন্ত্রিপরিষদের সভার পর কেবিনেট সেক্রেটারি জানালেন যে, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি। এবারেও পরীক্ষাটি হবে। মন্ত্রিসভায় এরকম হতে পারে কল্পনাও করা যায় না।

তবে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে হয় ‘সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ’। এখানে সবকিছু হতে পারে। তা না হলে একজন পূর্ণ কেবিনেট মন্ত্রীর কথা এভাবে উল্টে যেতে পারে? তিনি বলেছেন যে, আগে নাকি তিনি তার ব্যক্তিগত অভিমত দিয়েছিলেন। একজন পূর্ণ কেবিনেট মন্ত্রী যা বলবেন তা তো সব সময় সরকারের বক্তব্য বলে মনে করবে জনগণ। আর মন্ত্রী মহোদয় দেশের জন্য, জনগণের জন্য যা কল্যাণকর তা যদি তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও না করতে পারেন তাহলে তো তার পদত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিভিন্নভাবে খবর প্রকাশিত হয়েছে। একটি কাগজে একটি খবর দেয়া হয়েছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো পরীক্ষা বাতিলের মন্ত্রীর ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সচিবের ভিন্নমত ছিল। বাংলাদেশে এখন আমলাদের প্রচণ্ড দাপট। কোনো মন্ত্রীর পক্ষে এই দাপট উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আর ঐতিহ্যগতভাবে আমলারা জনবিমুখ এবং দাম্ভিক, তারা যেটা মনে করবেন সেটা করবেন। জনস্বার্থ বা কল্যাণের কথা তাদের কাছে বড় নয়। এই উপমহাদেশের আমলারা মূলত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির। পুরাতন বাতাবরণ ভেঙে নতুন বাতাবরণ তারা গড়তে চাইবেন না।

বর্তমান অবস্থায় যে বিষয়টিকে বড় করে দাঁড় করানো হচ্ছে, তাহলো পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলে বৃত্তি দেয়া হবে কিভাবে। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার দায়িত্ব বোর্ডের হাতে নেই। এটি পরিচালনার দায়িত্ব ন্যাশনাল একাডেমি অফ প্রাইমারি এডুকেশনের। পরীক্ষার ফলাফল দেয়া হয় উপজেলাভিত্তিক। অতএব বিষয়টি খুব সহজ।

প্রত্যেকটি স্কুল স্ব স্ব স্কুলের ছাত্রদের যোগ্যতা বিচার-বিবেচনায় নিয়ে কজন পরীক্ষা দেবে, তার তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠাবেন। ডিসেম্বরে পরীক্ষা হবে। প্রায় ছয় মাস সময় পড়ে রয়েছে। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির যে রকম উন্নতি হয়েছে এবং ডিজিটালাইজেশনের প্রয়োগও বেড়েছে, তাতে আগে যে কাজ ৩০ দিনে করা যেত, তা এখন তিন দিনে করা সম্ভব। আর সেটা নির্ভুলভাবেই করা যায়। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। অতএব অনেক কিছু ভাববার রয়েছে। অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং শিক্ষকের মান বাড়াতে হবে। সব ঠিক কথা। তবে যেসবের কথা আজকে বলা হচ্ছে তা তো আগেই বিবেচিত হওয়ার কথা ছিল, হঠাৎ করে এর আগমন হয়নি। অতএব সবকিছু বুঝেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা সেটা বুঝবে। এ নিয়ে অবাঞ্ছিত ও অনাকাক্সিক্ষত আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের প্রযোজন নেই। আর এসবের জন্য কোমলমতি শিশুকিশোরদের কষ্ট দেয়া হবে কেন। তারা তো অষ্টম শ্রেণিতে গিয়ে একটা সমাপনী পরীক্ষা দেবেই।

একজন অভিভাবক খুব সুন্দর একটা কথা বলেছেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার যে কোচিং সেন্টার চালু রয়েছে, সেখানে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের চেয়ে ছাত্রশিবির বেশ দক্ষতার সঙ্গে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে আসছে। জামায়াত-শিবিরের নজর ছিল তৃণমূল পর্যায়ে কোচিং বিজনেস দখল করা, এতে তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই লাভ। যা হোক রাজনৈতিক কারণে তারা হয়তো তাদের ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। তবে তাদের দৃষ্টি থাকবে এই ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্যের প্রতি যা অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে। বর্তমান জনগণের সরকার কেন বুঝতে পারছে না যে, এই পরীক্ষায় কোনো ইতিবাচক দিক নেই। বাচ্চাগুলো গার্মেন্টস শ্রমিকের মতো নাস্তা বেঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে সকাল আটটায় বের হয়, তারপর সকাল এগারোটায় স্কুলে গিয়ে গোগ্রাসে সেই নাস্তা গিলে ক্লাসে যায়। এদের তো সকালে মায়ের কোলে বসে নাস্তা খাওয়ার কথা। অথচ আনন্দময় শৈশবের বিনিময়ে যে সার্টিফিকেট তারা পায় তার কোনো মূল্য নেই, এটি হলো কোরা কাগজ। আমাদের প্রত্যাশা যে, সরকার অবিলম্বে অর্থাৎ এই বছর থেকে সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করে দেবে। জনগণের সরকার সব সময় জনগণের স্বার্থে কাজ করে থাকেন। নিশ্চয়ই সরকারও চাইবেন শিশুরা যেন ভারবাহী পশুর মতো কথিত সমাপনী পরীক্ষার ভারে ন্যুয়ে না পড়ে। আমাদের চাওয়া- শিশুদের অবাঞ্ছিত পরীক্ষার চাপমুক্ত করে তাদের চিত্ত বিকাশের এবং মানবিক গুণাবলি বিকাশের সুযোগ করে দেয়া হোক।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস ও কলাম লেখক।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।