বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন শেষ হতে না হতেই সোনার হরিণ নামে চাকরির পেছনে ছুটতে থাকেন শিক্ষিত বেকাররা। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পদের সংখ্যা থাকে হাতে গোনা, সেই তুলনায় চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক কয়েকগুণ বেশি।
সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব চাকরিতে আবেদন ফি বাবদ প্রার্থীদের গুণতে হয় শত শত টাকা। আর চাকরিদাতারা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবেদনকারীদের কাছ থেকে পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট বাবদ বুঝে নেন নগদ অর্থ। নিয়োগকর্তারা মনে করেন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে চাকরিপ্রার্থীরা আবেদন ফি দিতে বাধ্য।
বিসিএসসহ পিএসসির (সরকারি কর্ম-কমিশন) সব চাকরির আবেদনে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা চাওয়া হয়। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য ৩০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত পরীক্ষার ফি বাবদ নগদ অর্থ গুণতে হয়।
লিখিত পরীক্ষা, ইন্টারভিউ কার্ড কিংবা চাকুরির নিশ্চয়তা না থাকলেও বুঝে নেয়া হয় আবেদন ফি। আর এ টাকা নেয়া হয় বেকারদের কাছ থেকে। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রয়োজনের লোকবল নিয়োগ দেয়। কিন্তু নিয়োগসংক্রান্ত ব্যয়ের ভার বহন করতে হয় সেই সব বেকারদের। যারা প্রায় ১৭-২০ বছরনিজেদের খরচে লেখাপড়া করে রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
আবার তাদেরই রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার সুযোগ পাওয়ার জন্যও ফি দিতে হচ্ছে! এভাবে শিক্ষিত বেকারদের কাছে থেকে আবেদন ফি নেয়া কতটা যৌক্তিক?
নিয়োগকর্তাদের প্রশ্ন করা গেলে তারা হয়তো নিয়োগ-সংক্রান্ত খরচের কথাই বলবেন। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষার খরচ বহন করার দায়িত্ব কি বেকারদের? নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া, উত্তরপত্র মূল্যায়ন প্রভৃতি কাজে খরচ হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ খরচ কেন বেকারদের বহন করতে হবে?
প্রতিষ্ঠান যেহেতু নিজেদের প্রয়োজনেই নতুন কর্মী নিয়োগ দেয়। তাদের উচিত নিয়োগ-প্রক্রিয়ার সব ব্যয়ও বহন করা। প্রতিষ্ঠান যদি পুরোটা বহন করতে না চান; সে ক্ষেত্রে আবেদন ফি এমন হওয়া উচিত, যাতে নিয়োগ-সংক্রান্ত ব্যয়ের অর্ধেক বহন করবে প্রতিষ্ঠান, অর্ধেক চাকরিপ্রার্থীরা।
আগে বিসিএস পরীক্ষার ফি ছিল ৫০০ টাকা। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণদের আবেদন ফি বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭০০ টাকা। যেসব শিক্ষার্থীর নিজস্ব কম্পিউটার ও ইন্টারনেট-সুবিধা নেই, তাদের আবেদন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা খরচ করতে হয়। শুধু আবেদনেই শেষ নয়; একাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে চাকরির পরীক্ষার মিল না থাকায় প্রস্তুতি নিতে ভিন্ন ভিন্ন বইপত্রও কিনতে হয়।
আবার ঢাকাতে বেশির ভাগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বার বার ঢাকায় আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়াতে গুণতে হয় অনেক টাকা। টাকা না থাকায় অনেকেই আবেদন করতে পারেন না। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই টিউশনির টাকার ওপর নির্ভর করে নিজেদের খরচ চালার পাশাপাশি চাকরিযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সীমিত টাকায় চলতে গিয়ে যখন প্রতি মাসেই চাকরির আবেদনের জন্য বাড়তি গুণতে হয় কমপক্ষে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা; তখন তাদের বিপাকে পড়তে হয়।
৩৫ তম বিসিএস পরীক্ষায় ২ লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন। ৩৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় ২ লাখেরও বেশী আবেদন করেন। ৩৭ তম বিসিএসে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৬ জন আবেদন করেন। ৩৭ তম বিসিএসে সাধারণ প্রার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ধরা হলে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ কোটিরও বেশী।
একটি নিয়োগকার্য সম্পন্ন করতে এত টাকা ব্যয় হওয়ার কথা নয়। আর বিসিএসের বাছাইপর্ব থেকেই বাদ পড়েন সবচেয়ে বেশি প্রার্থী। তাদেরও কেন এত বেশী টাকা গুণতে হবে?
রাষ্ট্রায়ত্তসহ সব ব্যাংকে চাকরির আবেদন করতে প্রার্থীদের আর কোনো পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে না বলে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং বিধি ও নীতি শাখা থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এতে বলা হয়,‘রাষ্ট্রায়ত্তসহ সব ব্যাংকে চাকরির আবেদন ফি বাবদ কোনো পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট লাগবে না।’ প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ‘চাকরির আবেদনের সময় পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক ব্যয় ও কষ্টসাধ্য বিষয়। বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক চাকুরির আবেদন ফি না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
এর ফলে কোনো ধরনের ফি ছাড়াই ব্যাংকের যেকোনো নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন চাকরিপ্রার্থীরা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও কি বেকারদের জন্য এমন সুসংবাদ দিতে পারে না? কিছু বিদেশি সংস্থা রয়েছে; যেগুলোতে আবেদনে ফি গুণতে হয় না। যদিও এর আগে সরকারি চাকরিতে আবেদন ফি তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
উন্নত বিশ্বে বেকারদের কর্মসংস্থান হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকার তাদের ভাতা দিয়ে থাকে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত না হওয়ায় বেকারদের ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ব্যবসা করা অমানবিক।
চাকরি হোক আর না হোক, অন্তত সবাইকে বিনা ফিতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। আর আবেদন ফি যদি রাখতেই হয়, তাহলে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য ২০০ টাকা, লিখিত ও ভাইভার জন্য ৫০০ টাকা এবং অন্যান্য পরীক্ষার জন্য ১০০ টাকা নেওয়া যেতে পারে। কারণ এখন চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি।
লেখক: মো. মাহবুব আলম
[email protected]
সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।