প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক নিয়োগে আইনভাঙ্গার প্রতিযোগিতা

উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ও শিক্ষার্থীদের বিদেশগামিতা কমানোর লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯২ সালে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এরপর কেটে গেছে দুই যুগ। সময়ের পরিক্রমায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯৫টি। আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে উচ্চ শিক্ষার সনদ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাচ্ছে। দুই যুগ যেমন এই প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল খণ্ডকালীন শিক্ষক নির্ভর। তেমনি বর্তমানেও অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ বা প্রোগ্রামের খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা সংশ্লিষ্ট কোর্সের পূর্ণকালীন শিক্ষক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হওয়া যাবে না। মোট কথা, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই আইন অনুযায়ী পূর্ণকালীনের এক-তৃতীয়াংশের বেশি খণ্ডকালীন শিক্ষক রাখতে পারবে না।

বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। নামডাকওয়ালা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নামকাওয়াস্তে চলা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই চলছে খণ্ডকালীন শিক্ষকে ভর করে। এমনকি দেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিও (নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি) পথ চলার দুই যুগ পরও থেকেছে খণ্ডকালীন শিক্ষক নির্ভর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে আইনভঙ্গের হিড়িক দেখা দিয়েছে।

শিক্ষাবিদদের অভিযোগ, পূর্ণকালীন অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগে খরচ বেশি বিধায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে একাডেমিক কাজ পরিচালনা করছে। অন্যদিকে, বেরসকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরা দাবি করেছেন, দেশে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষকের সংকটের সৃষ্টি হয়েছে! তারা বলছেন, যেহেতু পূর্ণকালীন অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া কষ্টসাধ্য তাই তারা খণ্ডকালীন দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন। তবে, দু’একজন কর্তাব্যক্তি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করার কিছু অসুবিধা আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনেই আইন ভঙ্গের প্রতিযোগিতা করে গেলেও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। উল্টো, নিত্য-নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।

দেশে বর্তমানে কার্যক্রম চলমান আছে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর মধ্যে, ৫২টি প্রতিষ্ঠানের বয়স কমপক্ষে ৮ বছর। কোনোটি আবার চলছে ২২-২৪ বছর ধরে। এই ৫২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫০টির সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কমপক্ষে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়েই খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা পূর্ণকালীনের এক-তৃতীয়াংশের বেশি। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানে আবার পূর্ণকালীনরা সংখ্যালঘু। কারণ, ওইসব প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা পূর্ণকালীনের চেয়ে বেশি। অভিযোগ আছে, মুনাফালোভী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুইযুগ পথচলার পরও খণ্ডকালীন নির্ভর থেকেছে মুনাফা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই। এরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে টিউশন ফি নিলেও কম বেতনে ধার করা খণ্ডকালীন কিংবা তরুণ পূর্ণকালীন শিক্ষক দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ রাখে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান প্রতিষ্ঠানগুলোর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই নব্যপ্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খণ্ডকালীনে সমাধান খুজঁছে।

বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির পরিচিতি ব্যাপক। দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি দুই যুগের পথচলা শেষেও খণ্ডকালীন নির্ভরতা কমায়নি। চড়া টিউশন ফি আদায় করা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে অধ্যয়নরত আছে ১৮ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী। কিন্তু এই শিক্ষার্থীদের নর্থ সাউথ পাঠদান করাচ্ছে খণ্ডকালীন নির্ভর থেকে। যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে পূর্ণকালীন শিক্ষকের সংখ্যা ৪২৫ জন। অন্যদিকে খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা ৮৯৯ জন!

এই প্রতিষ্ঠানটির মতোই খণ্ডকালীনে মুনাফা সর্বাধিকরণের পন্থা খুজঁছে নামডাকওয়ালা প্রতিষ্ঠান ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ। এসব প্রতিষ্ঠানও খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বেশি। পূর্ণকালীন কম।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৩৪০ জন। এর মধ্যে পূর্ণকালীন হচ্ছেন ১৯৭ জন আর খণ্ডকালীন ১৪৩ জন। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৩১৪ জন। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নামকরা এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ১৮৪ জন পূর্ণকালীন ও ১৩০ জন আছেন খণ্ডকালীন ভিত্তিক। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ৩০৪ জন শিক্ষকের মাঝে খণ্ডকালীনের সংখ্যা ১৫০ জন।

এ ছাড়াও ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়াতে পূর্ণকালীন ২৯ জন শিক্ষকের বিপরীতে খণ্ডকালীনের সংখ্যা ৮৫ জন! চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটিতে পূর্ণকালীনের সংখ্যা মাত্র ৩৮ জন কিন্তু খণ্ডকালীন শিক্ষক আছেন ৫০ জন! মানারত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পূর্ণকালীন শিক্ষক ৮১ জন। প্রতিষ্ঠানটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক আছেন ৮৫ জন। একই অবস্থা চলছে পিপলস ইউনিভার্সিটিতে। প্রতিষ্ঠানটিতে পূর্ণকালীন শিক্ষক ৫৯ জন কিন্তু খণ্ডকালীন শিক্ষক আছেন ৯৫ জন। ইবাইস ইউনিভার্সিটিতে মোট শিক্ষক ১০৭ জন। এর মাঝে ৬৭ জনই খণ্ডকালীন!

উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলি ছাড়াও লিডিং ইউনিভার্সিটি, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, গ্রীন ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, রয়্যাল ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, দি বিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি ও দারুল ইসসান ইউনিভার্সিটিও ব্যাপক মাত্রায় খণ্ডকালীন নির্ভর। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে কমপক্ষে ৮-১০ বছর আগে। কোনোটি আবার প্রায় দুই যুগ আগে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যদি শুরু থেকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতো তাহলে এখন অবৈধভাবে খণ্ডকালীনে ভর করে কার্যক্রম চালাতে হতো না।

পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১২, ২০১৩ কিংবা ২০১৪ সালে অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও উল্লেখযোগ্য অংশই কার্যক্রম পরিচালনায় বেছে নিয়েছে খণ্ডকালীন নির্ভরতার পন্থা। অবশ্য কিছু নব্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন শিক্ষকের সংখ্যা আশাব্যঞ্জক।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সেকান্দার খান জানান, তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করেও পূর্ণকালীন অভিজ্ঞ শিক্ষক পান না। তার ভাষ্য, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার আগে সরকারের ভাবা উচিৎ দেশে চাহিদামাফিক অভিজ্ঞ শিক্ষক আছে কি না। এই শিক্ষাবিদ বলেন, চট্টগ্রামে ৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর মতো অভিজ্ঞ লোকবল না থাকলেও সরকার অনুমোদন দিয়েছে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে, প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে ধার করা শিক্ষকের উপর নির্ভর করে।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. এমএম শহিদুল হাসানের দাবি, দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পূর্ণকালীনের জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। তিনি অবশ্য জানিয়েছেন যে তার বিশ্ববিদ্যালয় খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কারণ খণ্ডকালীন দিয়ে কার্যক্রম চালালে তারা ঠিকমতো ছাত্রদের সময় দিতে পারেন না।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ অবশ্য মনে করেন যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পূর্ণকালীন শিক্ষকের ওপর নির্ভর হওয়ার কোনো সদিচ্ছাই নেই। এই শিক্ষাবিদের অভিমত, দেশের প্রায় ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মেধাবী বের হয়। তারপরও দেশে নিয়োগ দেওয়ার মতো মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের সংকট থাকার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের অভিযোগ, খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিতে কম খরচ তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়গুলো তাদের দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে বেশি বেশি মুনাফা অর্জন করছে। তিনি সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠোরতা অবলম্বন এবং রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব না দিতে। এই অধ্যাপকের ভাষায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা ও রাজনীতি থেকে দূরে রেখে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া উচিত।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।