নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপার দায়ে ২২ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার সিদ্ধান্ত

imagesপ্রাথমিক স্তরের নিম্নমানের বই ছাপার অভিযোগ প্রমাণিত

পাঠ্যবই ছাপার কাজে বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণ ঠেকাতে জোট বাঁধা ২২ ছাপাখানাকে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। অস্বাভাবিক কম দামে প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার কাজ নিয়ে নির্দিষ্ট শর্ত ও মান রক্ষা করতে না পারায় এই জরিমানার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জরিমানার পরিমাণ হবে কয়েক কোটি টাকা।

এনসিটিবির একাধিক সূত্র বলেছে, অস্বাভাবিক কম দরে কাজ নেওয়ায় ছাপাখানাগুলোকে অনিয়মের আশ্রয় নিতে হয়েছে। যে দরে তাঁরা কাজ নিয়েছেন, তা দিয়ে ৮০ গ্রাম সাদা কাগজ, নির্দিষ্ট উজ্জ্বলতা ও পুরুত্ব এবং চার রঙে মানসম্মত ছাপার সুযোগ ছিল না। ফলে সময়মতো বই দেওয়া সম্ভব হলেও এর মান নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে এনসিটিবি।

তবে, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে একই অপরাধে গত দুই যুগে কয়েকডজন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার সিদ্ধান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তা আদায় করা হয় না। কারণ প্রকাশক ও মুদ্রাকররদের সিন্ডিকেট সব সরকারের আমলেই শক্তিশালী। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থেকে  শুরু করে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অলিখিত চুক্তি থাকে। যুগ যুগ যাবত দেখা গেছে এই সিন্ডিকেটের ইঙ্গিতেই চলে এনসিটিবি। এক শ্রেণির সাংবাদিকের সঙ্গেও থাকে এই প্রকাশক ও মূদ্রাকর সিন্ডিকেটের সখ্য। এদের পছন্দ মতো প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করেন কেউ কেউ।

এনসিটিবির র্শীর্ষ সবগুলো পদেই পদায়ন দেয়া হয় বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের । যাদের থাকে না ব্যবসায়ীদের ডিল করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা। সুতরাং বাধ্য হয়েও তাদেরকে সিন্ডিকেটের মধ্যে চলে যেতে হয়।

অভিযুক্ত ২২ট প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চাইলে এনসিটিবির সচিব মো. ইমরুল হাসান বলেন, উপরের নির্দেশ ছাড়া দেয়া যাবে না্। কিছুদিন পর দেখা যাবে এনসিটিবি থেকে ২২ প্রতিষ্ঠানের তালিকাটিই উধাও হয়ে গেছে।

এনসিটিবি সূত্র বলেছে, গত বছরের দরপত্র এবং এখনকার বাজারদর পর্যালোচনা করে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড শুধু প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য ৩৩০ কোটি টাকা খরচের বিষয়টি প্রাক্কলন করেছিল। কিন্তু ২২ জন মুদ্রাকর ও প্রকাশক জোটবদ্ধ হয়ে ২২১ কোটি টাকায় কাজ করার দরপত্র জমা দেন। সরকার যে টাকায় কাজ করাতে চেয়েছিল, মুদ্রাকর ও প্রকাশকেরা তার চেয়ে ১০৯ কোটি টাকা কমে কাজ করতে আগ্রহ দেখান।

লট ভিত্তিতে তাঁরা দর দেওয়ায় সরকারি ক্রয়বিধির লঙ্ঘন না হলেও বাজারমূল্য অনুযায়ী এই দামে মানসম্পন্ন বই দেওয়া সম্ভব নয় বলে বিভিন্ন পক্ষ মত দেয়। দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) এই দরে কাজ না দেওয়ার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু সময়মতো বই দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করে সরকার ও দাতারা মুদ্রাকরদের বই ছাপার কাজ দিতে বাধ্য হয়।

ছাপাখানার মালিকরা বলেছেন, এনসিটিবির কাছে তাঁদের ৩৫ শতাংশ টাকা আটকে আছে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ হচ্ছে পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন (পিএলআই) বাবদ। এ ছাড়া বোর্ডের কাছে পারফরম্যান্স গ্যারান্টির (পিজি) ১৫ শতাংশ টাকা রয়েছে।

এনসিটিবি সূত্র বলেছে, প্রিন্টাররা ৩২ থেকে ৪১ শতাংশ কম দরে দরপত্র জমা দিয়ে বই ছাপার কাজ নিয়েছিলেন। এনসিটিবির তদন্তে প্রমাণ হয়েছে, বইয়ের সামগ্রিক মান এবার খারাপ হয়েছে এবং দরপত্রের শর্ত মানেননি মুদ্রাকরেরা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই বইয়ের মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। তাঁদের মতে, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এক বছর বইগুলো ব্যবহার করতে পারবে না।

এনসিটিবির নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা সাংবাদিকদের বলেন, ‘বইয়ের মান খারাপ হওয়ায় মুদ্রাকরদের আর্থিক জরিমানার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের সতর্ক করা হবে। তবে ২০১৭ সালের বইয়ের মান খারাপ হলে সংশ্লিষ্ট মুদ্রাকরদের আর্থিক জরিমানার পাশাপাশি কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।’

এদিকে কাগজের মান দেখভালের জন্য কন্টিনেন্টাল বিডি নামে যে প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটি কাগজ ও ছাপার মানে তেমন ত্রুটি খুঁজে পায়নি। এ জন্য এনসিটিবি ওই প্রতিষ্ঠানটিরও বিল আটকে দিয়ে এর কর্মকাণ্ড তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কন্টিনেন্টাল বিডির ব্যবস্থাপক সেখ বেলাল হোসেন বলেন, ‘দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী আমরা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছি। এনসিটিবির সাত সদস্যের কমিটির নেতৃত্বে কন্টিনেন্টাল কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক মান সংস্থা—আইএসওর নীতি অনুযায়ী মোট বইয়ের ১০ থেকে ২০ শতাংশের ওপর পরিদর্শন প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে, যেখানে ভালো ও মন্দ দুই ধরনের তথ্য আছে। তাই কন্টিনেন্টালকে দায়ী করার সুযোগ নেই।’

২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সাদা কাগজে প্রাথমিকের চার রঙের বই ছাপা হচ্ছে। তখন থেকে ভারতসহ কয়েকটি দেশের ছাপাখানা দরপত্রে অংশ নেওয়া শুরু করে। শুরু থেকেই দেশীয় প্রকাশকেরা বিদেশি ছাপাখানায় বই ছাপতে দেওয়ার বিরোধিতা করছিলেন। অন্যদিকে সরকারের যুক্তি ছিল, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজ হলে পাঠ্যবইয়ের মান বাড়বে।

বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, দেশীয় ছাপাখানাগুলো রক্ষার স্বার্থে বই ছাপার কাজ পাওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু এটা করতে গিয়ে পাঠ্যবইয়ের মানের সঙ্গে কিছুটা আপস করেছেন মুদ্রাকরেরা। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের বইয়ের মানের সঙ্গে কোনোরকম আপস করা হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিযোগিতায় বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজের সুযোগ পেলেও তা মেনে নেওয়া উচিত। সে জন্য বইয়ের মানের সঙ্গে আপস করা চলবে না।

২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ৭৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছেপে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করে সরকার। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ২৯২ কোটি, প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে ৩৮ কোটি এবং মাধ্যমিকে ৪৪৩ কোটি টাকা দর প্রাক্কলন করে এনসিটিবি দরপত্র আহ্বান করে। এই তিনটি স্তরেই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর পড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মুদ্রাকর বলেন, একদিকে অস্বাভাবিক কম দর দিয়ে কাজ নেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে কাজ নেওয়ার পর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যায়। সর্বশেষ মুদ্রাকরেরা জরিমানা গোনার মুখে। ফলে প্রত্যেকের এবার কমবেশি লোকসান হয়েছে।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।