কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি,১ এপ্রিল ২০২৩: স্নাতকে ভর্তির টাকা ছিল না। রিকশা চালিয়ে টাকা জমিয়ে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত আর্থিক অনটনে পড়ে বেশ কয়েকবার রিকশা চালাতে পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকায়। এত পরিশ্রম আর দৃঢ় মনোবল যায়নি বৃথা।
দারিদ্র্যকে ডিঙিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। কোনো উৎকোচ ছাড়াই সংগ্রামী সেই যুবক এ বছর একটি শীর্ষ স্থানীয় মাদ্রাসায় প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। রিকশাচালক থেকে তিনি এখন ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক।
আরো পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য সরকারি সংস্থা গঠন
কিন্তু কিভাবে তিনি তার স্বপ্নকে সত্যি করলেন? শিক্ষাবার্তার সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে তা জানালেন।
সংগ্রামী ও সফল এই যুবকের নাম মো. মমিনুর রহমান। তিনি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের মধ্যকুমরপুর গ্রামের মো. নুর ইসলাম-ময়না বেগম দম্পতির ছেলে। ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি এ বছর কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদ্রাসায় ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
মমিনুর জানান, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবনের সূচনা। হতদরিদ্র দিনমজুর বাবা পড়াশোনার খরচ দিতে হিমশিম খেতেন। শিক্ষক ও সুহৃদদের সহায়তায় এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন উচ্চমাধ্যমিকে। এ পর্যায়ে বারবার থমকে গেছে লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ। মা বিভিন্ন ভাবে টাকা জোগাড় করে দিতেন।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগে স্নাতক পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু অর্থের সংস্থান না হওয়ায় ভর্তি হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিছুতেই টাকার জোগাড় হচ্ছিল না। এ অবস্থায় নিরুপায় হয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে রিকশা চালাতে যান তিনি। উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন করে স্নাতকে ভর্তি হওয়া।
মমিনুর বলেন, ‘আমার বাবা একজন দিনমজুর। তাঁর পক্ষে আমার পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু আমি পড়াশোনা করে নিজের ও পরিবারের জন্য কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখতাম। ঢাকার কেরানীগঞ্জে গিয়ে একটি গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে কয়েক দিন রিকশা চালাই। ভর্তির প্রয়োজনীয় টাকা ছাড়াও কিছু উদ্বৃত্ত টাকা নিয়ে কুড়িগ্রামে ফিরে সরকারি কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হই।
‘এরপর যখনই টাকার সংকটে পড়েছি তখনই কেরানীগঞ্জে গিয়ে রিকশা চালিয়ে উপার্জন করেছি। অনার্স তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত আমি বাড়িতে ঈদ করিনি। প্রতি ঈদে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালিয়ে টাকা জোগাড় করেছি। এভাবে তৃতীয় বর্ষ শেষ করি। পরে চতুর্থ বর্ষে উঠে টিউশনি করে বাকি পড়াশোনা শেষ করি। এখনো টিউশনি করেই নিজের ও পরিবারের খরচ জোগাচ্ছি।’
‘আমার বাবাকে এখন আর কাজ করতে দিই না। বর্তমানে টিউশনির আয় দিয়ে পরিবার ও ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ বহন করেছি।’ যোগ করেন মমিনুর।
প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া মমিনুর বলেন, ‘১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ইংরেজি বিষয়ে সারা দেশে তৃতীয় হই। ১০ মার্চ এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদ্রাসায় ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। বাকি প্রক্রিয়া শেষে সেখানেই যোগদান করব। আমার এই ক্ষুদ্র সফলতায় যারা আমার পাশে ছিলেন, বিভিন্নভাবে আমাকে সহায়তা করেছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশেষ করে বিভিন্ন সময় পরামর্শ ও সহায়তা করার জন্য আমার বিভাগের সাবেক শিক্ষক মুকুল স্যারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
মমিনুরের চাকরি হওয়ায় খুশি তাঁর দিনমজুর বাবা নুর ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক খুশি। আল্লাহ রহমত করছে। টাকার অভাবে ছেলে নিজে কাজ করে পড়াশোনা করছে। এখন তার আয় দিয়ে আমার পরিবার চলছে। এর মধ্যে তার চাকরির খবরে আমি ও তার মা অনেক খুশি।’