উচ্চমাধ্যমিকে পৌঁছাতে পারেনি ১৩ লাখ শিক্ষার্থী

student1শিক্ষার্থীদের মান যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে সরকার। পিইসি শেষ করে মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়েছে ১০ লাখেরও অধিক শিক্ষার্থী। মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চমাধ্যমিকে পৌঁছাতে গিয়ে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখে।

বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, মেয়েদের উপবৃত্তি, ইংরেজি ও গণিতের অতিরিক্ত ক্লাসের পরও বন্ধ করা যাচ্ছে না ঝরে পড়ার হার। বরং দীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়াদের লাইন।

শিক্ষা পদ্ধতিতে সমাপনী পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

তিনি বলেন, ‘এ সময়ে একটি শিশু অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারে না। বিকাশের প্রথম ধাপেই যদি তাদের প্রতিযোগিতায় ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে তারা এগুবে কীভাবে? উন্নত বিশ্বে এ জাতীয় কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয় না।’

এ পদ্ধতিকে শিক্ষা ব্যবস্থার রুঢ় অবস্থা বলে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

এবার (২০১৬ সাল) মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এসএসসি), এসএসসি ভোকেশনাল এবং দাখিল সমাপনী পরীক্ষায় নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩ জন। এদের মধ্য নিয়মিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৭ জন। নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের এ ব্যাচটি ২০১০ সালে অংশ নিয়েছিল প্রাথমিক ও এবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায়। ওই বছর নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৮ জন।

দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছরের দৌড় শেষে মাধ্যমিক, ভোকেশনাল এবং দাখিল সমাপনী পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছাতে এদের মধ্যে থেকে ঝরে পড়েছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ জন শিক্ষার্থী। অথচ শিক্ষার্থীদের এ ঝরে পড়া বন্ধে সরকার অনেক আগে থেকেই বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি অব্যাহত রেখেছে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দেশের ৬১টি জেলার পিছিয়ে পড়া ১২৫টি উপজেলার ৫৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের গণিত ও ইংরেজি ভীতি দূর করতে অতিরিক্ত ক্লাস পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া। বরং দীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়াদের মিছিল।

সরকারের দেওয়া হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১০ সালের প্রাথমিক ও এবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায় মোট নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুপস্থিত এবং অকৃতকার্যের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৭২ হাজার ৩৫২ জন। সে হিসেবে ওই বছর পাস করেছে এমন শিক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার ৯৬৬ জন। এদের প্রত্যেককে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করেছে এমনটি ধরে নেওয়া হলেও ২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় তাদের মধ্য থেকে অংশ নেয়নি ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৮৬ জন এবং অকৃতকার্য হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ ওই স্তরে পাস করেছিল এমন শিক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ১০৯ জন। যাদের প্রত্যেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ভোকেশনাল এবং দাখিল সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে এমনটি ধরে নেওয়া হলেও ওই স্তরে এসে তাদের সংখ্যা ঠেকেছে ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৭ জনে। অর্থাৎ আবারো ঝরে পড়েছে ২ লাখ ১৮২ জন।

এদিকে, মাধ্যমিক ও সমমানের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নিয়মিত এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে অকৃতকার্য হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯২১ জন এবং উত্তীর্ণ হয়েও একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্যে আবেদন করেনি এমন শিক্ষার্থী ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৬ জন। অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে সব মিলিয়ে ঝরে পড়ার দলে পড়েছে ১৩ লাখ ১২ হাজার ৬৩৮ জন শিক্ষার্থী।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা প্রাক-প্রাথমিকের মধ্য দিয়ে না আসায় তাদের অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলে, আনন্দটা পায় না। তাই প্রাথমিকেই অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।’

তিনি আরো বলেন, ‘মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার মূল কারণ- সামাজিক এবং অর্থনৈতিক। দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ মেয়ে। যারা বাল্যবিয়ে এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়ছে। আর ছেলেরা যোগ দিচ্ছে কাজে। কারণ, পড়া-লেখার চেয়ে কোনো কর্মে যোগ দেওয়াটাই তাদের কাছে লাভজনক বলে মনে হচ্ছে।’

দেশের সব শিক্ষার্থীকে সাধারণ শিক্ষায় অংশ নেওয়ার ভাবনাটাও বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘তাই প্রতিটি স্তরে ফাঁকে ফাঁকে দরকার কারিগরি শিক্ষাসহ বিকল্প নানা সুযোগ। কিন্তু সেই বিকল্প সুযোগও আমরা দিতে পারছি না। ফলে যারা ঝরে পড়ছে, ধরে নিতে হবে, তারা পুরোপুরিই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পদ্ধতিটি যথাযথ নয়। এটি বন্ধ করা উচিত। তবে হুট করে সেটি করা সম্ভব নয়। ধারাবাহিকভাবে সেটি বন্ধ করতে হবে। তবে অষ্টম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা রাখা যায়।’

ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘প্রাথমিক লেভেলের একজন শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশে প্রয়োজন বিনোদন, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশিদার করা। কিন্তু বর্তমান পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে বিভিন্ন কোচিং, গা্ইড, প্রাইভেট, টিউটরের দ্বারস্থ হচ্ছে। এ কারণে মেধার সঠিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।’

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।