‘শিক্ষকরা আতঙ্কগ্রস্ত, হত্যার বিচার করে ভয় দূর করুন’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালন করা হয়। কালো ব্যাজ ধারণ করে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন শিক্ষকরা। এ সময় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকে।

কর্মসূচিতে বক্তারা বলেছেন, ‘শিক্ষকদের হত্যা বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকরা আজ আতঙ্কগ্রস্ত। অনেকেই একা একা বের হতে ভয় পান। এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করে সব ক্ষোভ, হতাশা, ভয় দূর করতে হবে।’

শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নতুন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ মঙ্গলবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাসমাবেশ সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১৫ মিনিট বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হবে। এ সময় সারা দেশের মানুষকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে একই সময় প্রদীপ প্রজ্বালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া আগামীকাল বুধবার খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।

এদিকে প্রিয় শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলনের দশম দিনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সকালে ক্যাম্পাসে প্রতীকী কফিন মিছিল বের করে তারা। পরে মৌন মিছিল বের করে ইরেজি বিভাগ। বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে রেজাউল করিম সিদ্দিকীর স্মরণে শোকসভা করেছে বাগমারা উপজেলা শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি। বিস্তারিত আমাদের আঞ্চলিক অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে—

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সকাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনের সামনে কালো ব্যাচ ধারণ করে অবস্থান নেন শিক্ষকরা। এ সময় সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. শহীদুল্লাহ্ বলেন, ‘রেজাউল স্যার হত্যার কারণে তাঁর পরিবার অভিভাবকহারা হয়েছে। আমরা সবাই আজ আতঙ্কগ্রস্ত। এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করতে হবে।’ এ ছাড়া বক্তব্য দেন অধ্যাপক সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক মো. ছাদেকুল আরেফিন, অধ্যাপক মো. তোফাজ্জল হোসেন, অধ্যাপক খোন্দকার ইমামুল হক, অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা, অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা প্রমুখ।

গতকাল সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন মিছিল করেছে ইংরেজি বিভাগ। এরপর ‘মুকুল প্রতিবাদ ও সংহতি মঞ্চে’ এক সমাবেশে অধ্যাপক রেজাউল করিমের মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভি বলেন, ‘আমাদের আগামীতে যেন এভাবে আন্দোলন করতে না হয়, রক্তপাত দেখতে না হয়। এ জন্য এ হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তারা যেই হোক না কেন তাদের ধরতে হবে।’ সমাবেশ থেকে গ্রীষ্মকালীন অবকাশেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বটতলায় কালো ব্যাজ ধারণ ও ক্লাজ বর্জন করে অবস্থান নেন শিক্ষকরা। এ সময় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বারবার শিক্ষকদের হত্যা বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। শিক্ষক হত্যার কোনো বিচারও হচ্ছে না। একের পর এক হত্যাকাণ্ডে গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’ অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘দলমত নির্বিশেষে দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা বলয় তৈরি করতে হবে। তা না হলে এই মৌলবাদী গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হবে না।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক সমিতি। সমাবেশে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলেও আসলে পরিস্থিতি ভালো না। খুনিদের ধরতে সরকার আন্তরিক নয়। আমাদের অনেক সহকর্মী একা একা বেরোতে ভয় পান। কারণ তাঁরা সংস্কৃতিমনা মানুষ, তাঁরা লেখালেখি করেন। এই দেশের যারা একটু প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা মানুষ তাঁরা যদি মনে করেন এক ধরনের বিপদের মধ্যে আছেন, থ্রেটের মধ্যে আছেন তাহলে অবস্থা স্বাভাবিক বলা যাবে না।’

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহিবুল আলমের সঞ্চালনায় সভাপতি ড. সৈয়দ সামসুল আলম বলেন, ‘প্রতিনিয়ত এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জঙ্গিগোষ্ঠীদের উসকে দিচ্ছে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বরে কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষকরা। সমাবেশে উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘এভাবে শিক্ষক হত্যা জাতির জন্য নিন্দাদায়ক।’ চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুকান্ত ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন, উপ-উপাচার্য ড. শিরীন আখতার, ডিনস কমিটির আহ্বায়ক ড. সেকান্দার চৌধুরী, প্রভোস্ট কমিটির আহ্বায়ক ড. সুলতান আহমদ, পালি বিভাগের ড. জিনবোধী ভিক্ষু, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ আলমসহ শিক্ষকরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ও মানবিকী বিভাগের ভবনের সামনে কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষক সমিতি। ‘আর কতকাল করবো শোক, সকল হত্যার বিচার হোক’ শিরোনামে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে বিভাগের শতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ ও সাংস্কৃতিক জোট।

এ ছাড়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন-৪-এর সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করেছেন বেরোবির শিক্ষকরা। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের করিডরে কর্মসূচি পালন করা হয়। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক সমিতি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের করিডরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ডুয়েটে কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষক সমিতি।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।