বেসরকারী শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সঙ্কটের মুখে

নির্বাচিতরা বাধার মুখে কাজে যোগ দিতে পারছেন না

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়েছে সারাদেশের বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া। কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার বিষয়ে আশার বাণী শোনালেও সঙ্কট এবার নতুন রূপ নিয়েছে। জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নিয়োগ পরীক্ষায় শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হলেও অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকসহ পরিচালনা পর্ষদের বাধায় যোগদানই করতে পারছেন না শিক্ষকরা। দফায় দফায় নির্বাচিতদের তালিকা প্রকাশ করা হলেও নিয়োগ পাওয়া স্কুল, কলেজে গিয়ে বাধার মুখে পড়ছেন হাজার হাজার শিক্ষক। কোথাও কোথাও গবর্নিং বডি যোগদানের বিনিময়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করছে। ব্যাপক ভুল ও তুঘলকিসব কর্মকা-ের মাধ্যমে প্রর্শ্নে মুখে পড়েছে পুরো পরীক্ষা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া।

এদিকে সঙ্কটের মুখে পড়া শিক্ষকরা ইতোমধ্যেই আন্দোলন শুরু করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের বিরুদ্ধে। আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক। সর্বশেষ ১৩ তম নিবন্ধন পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন প্রার্থীরা। নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের তুঘলকি কর্মকা-ের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেক শিক্ষক। তারা বলছেন, সংসদ সদস্যদের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি পদ থেকে অব্যহতি দিয়ে নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার শিক্ষা মন্ত্রণায়ের ঘোষণা রীতিমতো প্রহসনে পরিণত হয়েছে এনটিআরসিএর কর্মকা-ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বৃহস্পতিবার উত্তীর্ণদের নিয়োগ দিতে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেখানে নিয়োগে বাধা দিলে পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় মেধা তালিকা প্রকাশের পর একই সতর্কবাণী দিয়ে কোন ফল না পাওয়ায় এখন পৃথক আদেশ জারি করা হলেও ফল পাওয়্রা কোন আশা দেখছেন না শিক্ষকরা। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষায় বড় ধরনের সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা। জানা গেছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও ভোগান্তি কমাতে নতুন নিয়মে শিক্ষক নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করেছিল সরকার। এখন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ ও গবর্নিং বডির ক্ষমতা খর্ব করে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষকদের মনোনীত করে দেয় এনটিআরসিএ। কিন্তু নতুন নিয়মের এই শিক্ষক নিয়োগে ভোগান্তি কমার বদলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন মনোনীত শিক্ষকরা। এমনকি এখন পর্যন্ত দুই দফায় প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক চাকরি পেয়েও তাদের বেশিরভাগই এখনও যোগদান করতে পারেননি বলে তথ্য আসছে সারাদেশ থেকেই। কবে তারা যোগদান করতে পারবেন সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোনা তথ্য দিতে ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যাদের এই সমস্যার সমাধান করার কথা সেই এনটিআরসিএ সমাধান তো দূরের কথা, উল্টো উদ্ভটসব কর্মকা-ের মাধ্যমে নতুন নতুন জটিলতার জন্ম দিচ্ছে। আবার প্রতিষ্ঠানটিতে সমস্যার কথাও কেউ জানাতে পারছেন না। এমনকি গণমাধ্যমের প্রবেশও সেখানে প্রায় নিষিদ্ধ। এক মাসে অন্তত তিনবার সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছেন সেখানে।

এদিকে গত কয়েকদিন্ ধরেই সারাদেশ থেকে নির্বাচিত শিক্ষকদের হয়রানি, ঘুষ দিতে চাপ দেয়াসহ নানা তথ্য আসছে সরকারের কাছে। শিক্ষকরা সাংবাদিকদের কাছে পাঠাচ্ছেন অভিযোগের তথ্য। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর রমনা পার্কে শতাধিক শিক্ষক জড়ো হয়েছিলেন তাদের সঙ্কট সমাধানের পথ বের করার আশায়। যাদের একজন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেছেন, এনটিআরসিএ মহা কেলেঙ্কারি করছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ইচ্ছেমতো ব্যক্তিকে নিয়োগ দিচ্ছে। আবার নিয়োগ দিলেও হাজার হাজার শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে গেলে গবর্নিং বডি বলছে, তারা যোগদান করতে দেবে না। কারণ হিসেবে বলছে এ নিয়োগ তারা দেয়নি, এ নিয়োগ মানা হবে না।

নাটোরের গুরুদাশপুর উপজেলার হরদমা বহুমুখী কারিগারি বিএম স্কুল এ্যান্ড কলেজে ইংরেজীর প্রভাষক হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন মোঃ সবুজ সরকার। যার রোল নম্বর ৩০২০৩৭৮১।

তিনি বলেছেন, আমি পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়ে প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে গেলে কর্তৃপক্ষ না বলে দেয়। এখন আমি এনটিআরসিএর কাছে অভিযোগ দিলেও কোন সাড়া নেই। আমার মতো হাজার হাজার শিক্ষক এখন সঙ্কটে আছেন।

রাজশাহী থেকে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষিকা বলছিলেন, প্রথম তালিকায় তার নাম আসে। তিনি রাজশাহীর একটি কলেজের জন্য নির্বাচিত হলে সেখানে যাওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা বলেন, এখানে যোগদান করা যাবে না। ১০ লাখ টাকা দিলে যোগ দেয়া যাবে। এর পর উপায় না দেখে তিনি পরিচিতদের মধ্যস্থতায় আট লাখ টাকা দেয়ার কথা দেন। ইতোমধ্যেই ৫ লাখ টাকা দিয়েছেনও। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ শিক্ষিকরা যোগ দিতে পারেননি।

এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এতদিন শিক্ষক নিয়োগ দিত বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ বা গবর্নিং বডি। আর এতে একজন শিক্ষককে নিয়োগ পেতে ঘুষ দিতে হতো পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা। তাই সরকার বিধিমালা সংশোধন করে এনটিআরসিএকে শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে প্রথমবারের মতো চাহিদা চাইলে মাত্র ছয় হাজার ৪৭০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৪ হাজার ৬৬৯টি শূন্য পদের তালিকা দেয়। এসব পদের মধ্যে গত ৯ অক্টোবর ১২ হাজার ৬১৯টি পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচিত করে এনটিআরসিএ। এসব প্রার্থীর বেশিরভাগই এখন যোগদানের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।

মনোনীত প্রার্থীরা যখন নিয়োগের জন্য পরিচালনা পর্ষদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ঠিক তখনই এনটিআরসিএ নতুন একটি সার্কুলার জারি করে। সেখানে বলা হয়, যে সকল প্রার্থীকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে তাদেরকে এক মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ ও গভর্নিং বডিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়োগপত্র প্রদান করতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পরিচালনা পর্ষদ ও গবর্নিং বডি না থাকলে নিয়োগ স্থগিত থাকবে এবং নিয়মিত পর্ষদ গঠিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে। আর কোন পদে নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলে তা মেনে চলতে হবে। এখন যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কমিটি আছে সেখানেও নতুন বিপত্তির কারণে নিয়োগপত্র পাচ্ছে না শিক্ষকরা। বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ বা গবর্নিং বডি মনোনীতদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঘুষ দাবি করছেন। সেটা না দেয়ায় নিয়োগ দেয়াও হচ্ছে না।

এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান এ এম এম আজাহারের কাছে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে এনটিআরসিএর এক পরিচালক বলেন, মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকেই আমরা নির্দেশনা জারি করেছি। ফলে অনিয়মিত কমিটির নিয়োগ দেয়ার সুযোগ নেই। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। আগে কেন পরিপত্র জারি করলেন না এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যারা একাধিক প্রতিষ্ঠানে মনোনীত হয়েছেন তাদেরই এই বিষয়গুলো আগে খোঁজখবর নিয়ে প্রতিষ্ঠান পছন্দ করা উচিত ছিল। এতে তারা ঝামেলায় পড়ত না।

তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এনটিআরসিএর মনোনীত শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে পৃথক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সালমা জাহানের স্বাক্ষর সংবলিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশকৃত শিক্ষকদের নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এক মাসের মধ্যে নিয়োগপত্র জারি করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ম্যানেজিং কমিটিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। তবে যে সকল প্রতিষ্ঠানে কোন কমিটি নেই বা নিয়োগপত্র জারি করতে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে সেখানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশকৃতদের সুবিধার্থে নিয়োগপত্র জারি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি গঠনের পর ওই শিক্ষকদের নিয়োগপত্র ভূতাপেক্ষ অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে যে সকল বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন কমিটি নেই সে সকল প্রতিষ্ঠানকে অতিসত্বর কমিটি গঠনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এদিকে ১৩তম পরীক্ষায় ফেল করা শত শত বিক্ষুব্ধ শিক্ষক নিবন্ধন প্রার্থীরা ফল প্রত্যাহার চাকরির দাবিতে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের অফিসের সামনে লাগাতার আন্দোলন করছেন। বিক্ষোভকারীদের দাবি ৮০ নম্বর পেলেও তাদের ফেল দেখানো হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা খাতা দেখতে চান। ৮০ নম্বর পেয়েও কেন ফেল, তা জানতে চান।

জনকন্ঠ

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।