দীর্ঘ ২২ বছর বেতন-ভাতা পান না শিক্ষক-কর্মচারীরা

গাজীপুর প্রতিনিধি : ২৬ এপ্রিল : জেলার শ্রীপুর উপজেলার চিনাশুখানিয়া গ্রামের দিঘির চালা উচ্চ বিদ্যালয়টি দীর্ঘ ২২ বছরেও এমপিওভুক্ত হয়নি। দীর্ঘ সময়ে স্কুলটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা।

অপরদিকে অবহেলিত রয়েছে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থেকে। সেই সঙ্গে এলাকাবাসীর অনুদানের ওপর ভর করে কোনো রকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে অজো পাড়াগাঁয়ের এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।

এলাকার জনহিতৈষী ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় ১৯৯৫ সালে উপজেলার রাজাবাড়ি ইউনিয়নের চিনাশুখানিয়া এলাকায় গ্রামবাসীর প্রচেষ্টায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়টি ১৯৯৯ সালের পহেলা জানুয়ারি শিক্ষাবোর্ড থেকে পাঠদানের অনুমতি এবং ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি মাধ্যমিক পর্যায়ে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়ে প্রতিবারই পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের অবদান রাখছে।

অবহেলিত গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষার আওতায় আনার লক্ষে এক একর সাড়ে ৬৩ শতাংশ জমির উপর জামাল উদ্দিন মাঝি ও আব্দুর রশিদ বেপারি জমি দিয়ে ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ২০০০ সালের ২ জুন গাজীপুর-৩ আসনের বর্তমান সাংসদ ও তৎকালীন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলী এমপি নতুন ভবন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে এলাকাবাসী ও শিক্ষকমণ্ডলীর নিজস্ব অর্থায়নে আঁধাপাকা ইটের তৈরি তিনরুমের একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। যা আজও বিদ্যমান রয়েছে। পরবর্তীতে চারপাশে টিনের ছাউনি দিয়ে তিনটি শ্রেণিকক্ষ তৈরি করে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়।

বর্তমানে টিনশেড শ্রেণিকক্ষের টিন ছিড়ে পেছন দিক থেকে ফাঁকা হয়ে গেছে। একটি শ্রেণিকক্ষও পাঠদান উপযোগী নয়, একটি মাত্র অফিস কক্ষ, শিক্ষার্থীদের বসার জন্য নেই পর্যাপ্ত বেঞ্চ, যা আছে তাও ভাঙা। এছাড়া টয়লেটের পরিবেশও নোংরা। এই টয়লেট ব্যবহারের ফলে দুগন্ধে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শ্রীপুর উপজেলা সদর হতে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটিতে একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত নেই নিজস্ব খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, মেয়েদের জন্য কমন রুম, পানির ট্যাঙ্কি, বিজ্ঞানাগার, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির গ্যালারি ও শহীদ স্মৃতিফলকসহ অনেক কিছুই।

সরকার শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের আলোকে ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ৬ষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার স্তর পর্যন্ত আইসিটি বিষয় বাধ্যতামূলক করলেও প্রতিষ্ঠানে ‘আইসিটি’ বিষয়ের শিক্ষক তো দূরের কথা একটি কম্পিউটার ল্যাব পর্যন্ত নেই। একারণে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ বা আইসিটি ও কম্পিউটার শিক্ষার ছোয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

এ বিদ্যালয়টিতে প্রতিষ্ঠালগ্নের কিছু সময় পর থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন কাজিম উদ্দিন ভুঁইয়া, সহকারী শিক্ষক হিসেবে জালাল উদ্দিন (গণিত), পাপিয়া ইয়াসমিন (বাংলা), আমজাদ হোসেন (ধর্ম), প্রদীপ চন্দ্র সরকার (বিজ্ঞান), আকবর হোসেন (ব্যবসায় শিক্ষা) ও আনোয়ার হোসেন (ইংরেজী) দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

এদের মধ্যে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সনদ প্রধান শিক্ষক ব্যতিত কারোর নেই। এছাড়া প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একমাত্র অফিস সহকারী হিসেবে রীনা বেগম স্কুলটিতে কাজ করে যাচ্ছেন।

বিদ্যালয়টিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ২০ জন ছাত্র ও ২০ ছাত্রী, ৭ম শ্রেণিতে ২০ জন ছাত্র ও ২৫ ছাত্রী, ৮ম শ্রেণিতে ১৭ জন ছাত্র ও ১৩ ছাত্রী, ৯ম শ্রেণিতে ১৫ জন ছাত্র ও ২০ ছাত্রী এবং ১০ম শ্রেণিতে ১৭ জন ছাত্র ও ২৩ ছাত্রীসহ সকল শ্রেণিতে মোট ১৯০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

বিদ্যালয়টিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ৮০টাকা, ৭ম ও ৮ম শ্রেণির ১০০, ৯ম ও ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ১২০ টাকা করে বেতন নির্ধারিত। সেই সঙ্গে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোচিং ফিসহ ফরম পূরণের জন্য নেয়া হয় ২ হাজার ৫০০ টাকা করে। এদের থেকে আদায়কৃত অর্থ দিয়ে দু’তিন মাস পরপর শিক্ষকরা মাত্র দুই হাজার টাকা করে বেতন পান। যা খুবই সামান্য।

একারণে প্রতিষ্ঠার ২২ বছরেও প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হওয়ার ফলে সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশেষ করে গত ২২ বছর বিনা বেতনে কাজ করছেন শিক্ষক-কর্মচারী। বর্তমানে সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবতের জীবন যাপন করছেন।

প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রতি বছর জেএসসি এবং এসএসসিতে একাধিক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ লাভ করলেও অবকাঠামোগত দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটির কোনো উন্নয়ন হয়নি। ২০১৬ সালের জেএসসি পরীক্ষায় ৩৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন এ প্লাসসহ বাকি সবাই এ গ্রেড পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে গেল বছরের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল মাত্র ৫২%। ১৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮জন পাস করেছিল।

এলাকার ৪ কিলোমিটারের মধ্যে একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থাকলেও আর কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়টি অবহেলিত এলাকার ছেলে-মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। অনুরূপভাবে কর্মরত রয়েছে ৭ জন শিক্ষক ও ১ জন কর্মচারী। যদিও প্রয়োজন ১১ জন শিক্ষকের। বিদ্যালয়ে তিনটি বিভাগ খোলা থাকলেও বিজ্ঞান বিভাগে একজন শিক্ষকও নেই।

প্রতিষ্ঠানটি এতো সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও খুবই দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে পরিচালনা পরিষদে সভাপতি হিসেবে শ্রীপুর থানা যুবলীগের সভাপতি কমর উদ্দিন দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া সংরক্ষিত ১ জন, শিক্ষক প্রতিনিধি ৩ জন, অভিভাবক প্রতিনিধি ৪ জন ও একজন দাতা সদস্যসহ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১২ জন সদস্য রয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজিম উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে পুস্তক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও আজও এমপিওভুক্ত করা হয়নি। বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত করার লক্ষে আমাদের এমপি মহোদয় এ বিষয়টি একাধিকবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন।

তিনি জানান, সরকার বিদ্যালয়টি স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এমপিওভুক্ত না হওয়ায় আমরা শিক্ষক-কর্মচারীরা কেউ বেতন ভাতা পাই না। গত ২২ বছর এভাবেই বিনা বেতনে কাজ করতে গিয়ে শিক্ষক-কর্মচারী সবাই হাঁপিয়ে উঠেছি। বর্তমানে পরিবার-পরিজন নিয়ে সকলের পরিবার মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বলে প্রধান শিক্ষক জানিয়েছে।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কমর উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ ২২ বছর শিক্ষকেরা বিনা বেতনে পাঠদান করতে গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দীর্ঘদিনেও এমপিওভুক্ত না হওয়ার ফলে প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। শিক্ষক-কর্মচারী পরিবারের মানবিক দিক বিবেচনা ও অবহেলিত এলাকার ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার কথা বিবেচনা করে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত করার দাবি জানান তিনি। সেই সঙ্গে আগামী এক বছরের মধ্যে বিদ্যালয়টি এমপিও হবে বলেও তিনি আশাবাদী।

স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা আ: রশিদ বলেন, স্কুলটি এমপিওভূক্তি করার ব্যাপারে বহু চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। শিক্ষকদের মানবেতর দিন বিবেচনা করে ব্যক্তিগতভাবে কিছু টাকা দিয়ে তাদেরকে চালিয়ে রাখছি।

এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকা সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা পান না, এটা খুবই কষ্টের ব্যাপার। তবে বিদ্যালয় এমপিও হওয়ার বিষয়টি মূলত স্থানীয় সংসদ সদস্যের দায়িত্ব। এছাড়া কোনো বিদ্যালয়ের যদি বয়স অনেক দিন হয় ও শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি থাকে এবং ফলাফল যদি ভালো হয় তাহলে এমপিও হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

অতিদ্রুত এমন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এমপিওকরণের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

শ্রীপুর উপজেলায় মোট ১৭টি বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত ছাড়াও চলছে। তাই শিক্ষকদের মানবেতর দিন বিবেচনা করে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্ত করার জোর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসী।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।