ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দৈন্যদশা

ডেস্ক: প্রতিষ্ঠার অর্ধশত বছর পরও কোনো কোনো বিদ্যালয়ের নেই নিজস্ব জমি ও স্থায়ী ভবন। খেলার মাঠ নেই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। কোথাও কোথাও পরিত্যক্ত শ্রেণিকক্ষে চলছে পাঠদান। বৃষ্টি হলে ভবনের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে ভিজে যায় মেঝে। কোনো কোনোটি ঝুঁকিপূর্ণ, ধসে পড়তে পারে যেকোনো সময়। কয়েকটি বিদ্যালয়ে নেই বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। সাইনবোর্ড থাকলেও নেই বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব। শিক্ষার মান নি¤œমুখী বলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। স্বল্প আয়ের দিনমজুর শ্রেণির পরিবারের শিশুরাই প্রধানত শিক্ষার্থী। সরেজমিনে ঘুরে ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এমন বেহাল দশা দেখা যায়।

অবকাঠামোগত দুর্বলতার পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোতে আছে শিক্ষক সংকট। পাঠদানে শিক্ষকদের উদাসীনতা দেখার কেউ নেই। বিভিন্ন এলাকার কমপক্ষে ত্রিশটি বিদ্যালয়ের সামনে রয়েছে ময়লার ভাগাড়, কিংবা প্রধান ফটকের সামনে বসছে হাটবাজার। দখল হয়ে আছে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার একমাত্র পথটি। সরকারি জমি দখল করে পশু বিক্রির স্থায়ী হাট বসানোয় কাপ্তানবাজার এলাকার খোদাবক্স সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি এখন তালাবদ্ধ।

তথ্যমতে, রাজধানীতে আছে ২৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত লাখের কাছাকাছি। বস্তির বাসিন্দা, রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, পোশাককর্মীর মতো নিতান্তই স্বল্প আয়ের মানুষের সন্তানদের শিক্ষাদানের ঠিকানায় পরিণত হয়েছে বিদ্যালয়গুলো। তাই ‘গরিবের পাঠশালা’ নামে পরিচিত এসব প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সরকারের অনেক প্রতিশ্রুতিরই বাস্তবায়ন নেই। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের দাবি, ‘সমস্যা চিহ্নিত করে কোন বিদ্যালয়ে কী করতে হবে, এ অনুযায়ী, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

রাজধানীর নাজিরা বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। বিদ্যালয়ের সামনের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা। বিদ্যালয়ের নেই নিজস্ব ভবন ও জমি। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা জাহান আরা জানান, বিদ্যালয়টিতে ৩৩৬ জন শিক্ষার্থী আছে। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহাগী মনি বলে, ‘ওর বাবা রিকশাচালক। নিয়মিত পাঠদান হয় না বলে বিদ্যালয়ে এসে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলে।’ মাঠ থাকলে খেলতে বেশি ভালো লাগত বলে জানায় সে।

কোতোয়ালির জিন্দাবাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ের নেই পাকা ভবন ও খেলার মাঠ। টিন শেডের আধাপাকা একটা বাড়ির ছোট ছোট তিনটি কক্ষে গাদাগাদি করে পাঠদান চলে। বৃষ্টি হলে কক্ষ ভিজে যায়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শিল্পী খাতুন  জানান, ‘শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে গাদাগাদি করে বসতে হয়। এ জন্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে এখন আছে মাত্র ৭২ জন। শিক্ষক আছেন পাঁচজন।’ পাকা ও স্থায়ী ভবন নির্মাণ করতে কয়েকবার আবেদন করা হলেও তাতে কাজ হয়নি বলে তিনি জানান।

সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি এলাকার কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা বেশি বেহাল। রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি জরাজীর্ণ। এর পাশে দুই কক্ষবিশিষ্ট পিডিবির একটি নতুন ভবনে একই সঙ্গে পাঠদান ও দাফতরিক কাজ চলে। মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বাজারসংলগ্ন বলে এর সামনে প্রায় সব সময় ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। এ এলাকার আহম্মদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে একটি ডোবা। এর থেকে প্রচ- দুর্গন্ধ ছড়ায়। শ্রেণিকক্ষের পরিবেশও ভারি করে তোলে দুর্গন্ধ। বৃষ্টি হলে বিদ্যালয়ের মাঠে পানি জমে যায় বলে জানায় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইমন খান।

অনুসন্ধান বলছে, ডেমরার সারুলিয়া, কামারগোপ, কোতোয়ালির মাহুতটুলী রেনেসাঁ, ছোট কাটরা, হযরত নগর ও চম্পাতলী, গোয়ালঘাট, লালচাঁন ও পাড়া ডগাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার সার্বিক পরিবেশও নাজুক।  ভবন পুরনো, খেলার মাঠ না থাকাসহ শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশের সংকট হওয়ায় অনেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়াতে আগ্রহী হচ্ছেন না।’

আবার ভিন্ন চিত্রও দেখা যায়। শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. আমিনউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা ১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস যৌথভাবে উদ্বোধন করেন। বিদ্যালয়টিতে পাঠদান শুরু হয় পরের বছর ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে। তবে শিক্ষার্থী সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। সব শ্রেণি মিলিয়ে আছে মাত্র ৩৫ জন। জুরাইন বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ তুলনামূলক অনেক উন্নত। তবে এ বিদ্যালয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা নেই বলে জানান শিক্ষক আসাদুজ্জামান। মিরপুরের সরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সেনপাড়া পর্বতা। আড়াইতলার বর্গাকৃতির ভবনটির সামনে একটি খেলার মাঠও আছে। ১৯ জন প্রশিক্ষিত শিক্ষক আছেন। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও সন্তানকেও নিজের বিদ্যালয়ের বদলে পড়াচ্ছেন বেসরকারি অন্য বিদ্যালয় ও কিন্ডার গার্টেনে। এরকম ১০জন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ‘শুধু শিক্ষকের সংকট নয়, সরকারের জবাবদিহি ও সুষ্ঠু পরিচালনা নীতির অভাবে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান একেবারে নি¤œমুখী। এসব বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ঝামেলা পোহাতে হয়।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তাও রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জীর্ণদশা ও এসব বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর মানসম্পন্ন বিদ্যালয়ে ভর্তির ঝামেলার বিষয়টি স্বীকার করেন। মন্ত্রণালয় জানায়, ঢাকার প্রান্তিক এলাকায় শিক্ষার উন্নয়নে ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যেখানে প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। নবীনগর, ইপিজেড, ধামরাই, পূর্বাচল, হেমায়েতপুর, জোয়ারসাহারা, সাইনবোর্ড, চিটাগাংরোড, শাহজাদপুর ও ঝিলমিল এলাকাগুলোতে ১০টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। চলতি সময় থেকে জুন ২০১৯ মেয়াদে বিদ্যালয় ১০টি স্থাপন হবে ৬৭৪ কোটি টাকা খরচে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সরকারি মাধ্যমিক-১) সমীর কুমার বিশ্বাস জানান, ‘দশটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বিদ্যালয়গুলোতে প্রান্তিক শিক্ষার্থীর সুযোগ-সুবিধা থাকবে।’

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।