কোচিংয়ের নামে শিক্ষার্থী শোসন বন্ধে প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ
হারুন রাজু : সন্তানদের উচ্চ ও সুশিক্ষার আলোকে গড়ে তুলতে চায় সকল অভিভাবক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই মানুষ তৈরীর কারখানা। অথচ সে কারখানাগুলো কি হচ্ছে আজ ? মাত্র এক যুগ আগেও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দেখা যেতোনা অর্থের লালসা। অকৃপ্রনভাবেই সন্তানের মতো করেই শিক্ষাদান করাতেন শিক্ষাকরা। সেকালের শিক্ষকদের শাসন, আদর ও ভালোবাসা আলোকিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছে কতশত শিক্ষার্থী। এখনো শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য যারা জনম জনম স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তাদের মধ্যে রয়েছেন আশুতোষ সেন গুপ্ত, আনিসুর রহমান, আরজ আলী, হোসেন আলী, সদর আলী, আগস্টিন হালসনা, মঈনুদ্দিন, নাহার উদ্দিন, ইলিয়াস হোসেন, আ. কুদ্দুস, আবু বকর, শহিদুল্লাহ, দাউদ আলী, জামাত আলী, আফতাব উদ্দিন সহ নাম না জানা আরো অনেক শিক্ষক।
সে সময় শিক্ষকরা অল্প বেতনে শিক্ষকতা করলেও তাদের মধ্যে ছিলোনা অর্থের মোহ। শ্রেনী কক্ষে শিক্ষার্থীরা পড়া না পারলে নিজের আগ্রহেই সেই শিক্ষার্থীকে বিনাপয়সায় পড়াতেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের খুজে বের করে তাদের উচ্চ শিক্ষার স্বর্ণ শিখরে পৌছে দেয়ার প্রচেষ্টায় মেতে থাকতেন সেই সকল আদর্শিক শিক্ষকরা।
বর্তমান অবস্থার দিকে খেয়াল করলে মনে হয় পুরোটাই উল্টো। বর্তমান শিক্ষকরা শিক্ষাদান নয় টাকা উপর্জনের লড়াইয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নিরক্ষর মুক্ত সমাজ, জাতী ও দেশ গড়ার লক্ষে শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার নানামুখি কর্মসূচি গ্রহন করেছে। বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যপুস্তক তুলে দিয়ে সরকার সৃস্টি করেছে নতুন অধ্যায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে দূর্নিতি দুরিকরণে সরকারের যেমন আন্তরিকতার কমতি নেই, তেমনি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো থেকে শুরু করে সব ধরণের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেই আন্তরিকতার ঘাটতি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আধুনিক দেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর, আধুনিক প্রযুক্তিতে শিক্ষাদানের জন্য ব্যয় করছে প্রচুর অর্থ, শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানো সহ দেয়া হয়েছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, ঠিক তখনি অর্থলোভি এক শ্রেনীর শিক্ষক হয়ে উঠেছে বেপরায়া। তারা শিক্ষা নয়, অর্থের লোভেই মেতে উঠেছে। শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করে হাতিয়ে নিচ্ছে প্রচুর অর্থ, কলূষিত করছে শিক্ষাঙ্গনকে।
দর্শনার অভিভাবক মহলের দীর্ঘদিনের অভিযোগ কোচিং সেন্টার পরিচালিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যালয়ে কোচিংয়ে পড়াতে না দেয়া হলে শ্রেনী কক্ষে রিতিমত অপমান সহ বিভিন্নভাবে ভৎসনা করা হয়ে থাকে শিক্ষার্থীকে। তাছাড়া পরীক্ষার খাতায় ভালো লিখলেও নাম্বার কম দেয়ার অভিযোগতো রয়েছেই।
সম্প্রতি সময়ে দর্শনার বেশ কয়েকজন শিক্ষক কোচিং বানিজ্য করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। দালান-কোটা, জমিজমা, গাড়ি ক্রয় সহ ব্যাংক এ্যাকাউন্ডে নামে-বেনামে জমা রাখা হয়েছে প্রচুর অর্থ।
দর্শনার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, কেরুজ উচ্চ বিদ্যালয়, দক্ষিণচাদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মেমনগর বিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আলহেরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ক্লাশের নামে খোলা হয়েছে কোচিং বানিজ্য সেন্টার। সাধারণত কোন কোন শিক্ষার্থী ইংরেজি ও অংকে অল্প বুঝে থাকে। সেক্ষত্রে সরকার ইংরেজি ও অংকের জন্য অতিরিক্ত ক্লাশ করানোর ব্যবস্থা চালু করে। প্রতিটি বিষয়ে ১৫০ টাকা হারে দুটি বিষয়ে ৩০০ টাকা মাসে ১২ দিন ক্লাশ করানোর নিয়ম থাকলেও গোড়া থেকে চারাগাছ গজিয়ে তুলেছেন শিক্ষকরা।
অভিযোগ উঠেছে, অতিরিক্ত ক্লাশের টাকা বিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রেখে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করার নিয়ম ছিলো। অথচ সে টাকার চারআনাও রাখা হয়না বিদ্যালয়ের তহবিলে। পুরো টাকায় ঢুকছে শিক্ষকদের পকেটে। দর্শনায় কোচিং বানিজ্যের সাথে যেসকল শিক্ষকদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন, মেমনগর বিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিন আহমেদ, সাবিনা ইয়াসমিন, হাফিজুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, শামসুন্নাহার, আ. কাদের, দর্শনা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের কামাল উদ্দিন, খোরশেদ আলম, নাসরিন আক্তার শিলু, আরিফুল ইসলাম শান্ত, হাফিজুর রহমান, হাসান আলী, কেরুজ উচ্চ বিদ্যালয়ের নাছিমা আক্তার, আ. রহিম, ফারুক হোসেন,স্নেহময় বশাক নান্টু, নুরুল ইসলাম, আসমা খাতুন, আশরাফ হোসেন, ইকবাল রেজা, দক্ষিণচাঁদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লিয়াকত আলী, আক্তারুজ্জামান সহ ৬/৭ জন।
এ ছাড়া রয়েছে আলহেরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রসাশক দায়িত্বভার গ্রহনের পরপরই শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। কোচিং বানিজ্যের ব্যাপারে তিনি কয়েকবার হুশিয়ার করেছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রসাশক জিয়াউদ্দিন আহমেদ। জেলা প্রশাসকের হুশিয়ারি অনেকটাই তোয়াক্কা না করেই দেদারছে কোচিং বানিজ্য চলছিলো অর্থলোভি শিক্ষকরা। দর্শনা কেরুজ হাই স্কুল, দক্ষিণচাঁদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দর্শনা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় , মেমনগর বিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আলহেরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকরা কোচিং বানিজ্য চালিয়ে আসছে।
মোটা অংকের বেতনে অনিচ্ছা সত্তেও সচ্চল পরিবারের সন্তানেরা কোচিংয়ে অংশ নিতে পারলেও বিপাকে পড়তে হয়েছে স্বল্প আয়ের মানুষের সন্তানরা। কোচিংয়ে ভর্তি না হওয়ায় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ ও অপমান-অপদস্ত করতে দ্বিধাবোধ করেনি অভিযুক্ত অর্থলোভি শিক্ষকরা। বর্তমান সময়ে অনেকটাই কোচিং বানিজ্যের কারণে ঝড়ে পড়েছে বহু মেধাবি শিক্ষার্থী।
দর্শনার বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টার বন্ধ ও অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অভিভাবকদের দাবী বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। দেরিতে হলেও সময় উপযোগি পদক্ষেপ গ্রহন করেছে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন। খানেকটা আকস্মিকভাবেই গত সোমবার বিকাল ৩ টার দিকে কোচিং চলাকালীন সময়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন আহমেদের নির্দেশে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয় দর্শনা কেরুজ হাই স্কুল ও মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। দুটি বিদ্যালয়ে কোচিং বানিজ্য হাতেনাতে ধরে ফেলেন প্রতিনিধিদল। বালিকা বিদ্যালয়ে প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থীকে কোচিংরত অবস্থায় পাওয়া গেলেও কেরুজ হাই স্কুলে পাওয়া গেছে প্রায় সাড়ে ৩শ শিক্ষার্থী।
এ সময় কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শোনেন নানাবিধ অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের অভিযোগে বলা হয়, ৬ষ্ঠ শ্রেনী থেকে ১০ শ্রেনী পর্যন্ত কোচিং বাধ্যতামূলক করেছে শিক্ষকরা। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ৬শ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কোচিং ফি নিয়ে থাকেন। কোচিংয়ে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে ফরম পূরণের ব্যবস্থা ও অভিনব কৌশল। কোচিং ক্লাশ সহ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ভিডিও ধারণ করেন কর্মকর্তারা। শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে না আসার জন্য বলে দেন প্রতিনিধিদলের কর্মকর্তারা। কোচিং বানিজ্যে কেরুজ হাই স্কুলের মিক্ষক নাছিমা খাতুন সহ বেশ কয়েকজন জড়িত থাকলেও তারা সুযোগ বুঝে সটকে পড়ার অভিযোগ উঠে। পরপরই কর্মকর্তাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে অভিযুক্ত শিক্ষকদের। অভিযুক্ত দর্শনা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একেএম হুমায়ন কবির, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষিকা নাসরিন আক্তার শিলু, সহকারি শিক্ষক হাফিজুর রহমান হাফিজ, দর্শনা কেরুজ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইকবাল রেজা, আশরাফ হোসেন, স্নেহময়‡ বসাক নান্টু, ফারুক হোসেন, আসমা খাতুন অভিযান পরিচালনকারি কর্মকর্তাদের কোন প্রশ্নের সদত্তোর দিতে পারেননি। ফলে এ ৯ শিক্ষককের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমান সহ উপস্থাপন করা হয়েছে জেলা প্রশাসকের নিকট। অভিযুক্ত ৯ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে লেখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়া উদ্দিন আহমেদ। কেরুজ হাই স্কুলের কোচিংয়ের অর্থ আদায়কারি রুটো ব্যাবহারকারি শিক্ষক নাছিমা খাতুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য দাবী তুলেছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।।