শিক্ষামন্ত্রণলায়ের অনবরত নানাবিদও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গিনিপিগ হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা

আশিক রহমান: উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি যুগোপযোগী করার ফলে ফলাফল সঠিক হয়েছে। অর্থ্যাৎ তিনি বেশ আত্মতৃপ্তি বোধ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, তিনি তার এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, এর আগের পদ্ধতি সঠিক ছিল না। তাহলে আগের ফলাফলগুলো নিয়ে তো আমাদের প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। আবার এখন যে পদ্ধতির কথা তিনি বললেন, তার থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, উত্তরপত্র একটা মডেল হিসেবে শিক্ষামন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ডে তৈরি করা হয়েছে। এবং সেই অনুযায়ী পরীক্ষকদের খাতা দেখতে বলা হয়েছে। এমন পদ্ধতি অবিশ্বাস্য, সন্দেহজনক ও যুক্তিহীন। কারণ এমন পদ্ধতি সারা পৃথিবীর কোথাও নেইÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, মডেল অনুসরণ করেই যদি ছাত্র-ছাত্রীদের লিখতে হয় তাহলে দুটি সমস্যা আছে। ছাত্রী-ছাত্রীরা তো আগাম কোনো ধারণা পাচ্ছে না যে, এই প্রশ্নের ওই উত্তর হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছেÑ তাদের মেধা, মনন বিকাশের জন্য যে, স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা বা সৃজনশীলতার প্রয়োজন সেটি কিন্তু বাধাগ্রস্ত হলো। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি যুগোপযোগী নয়, বরং যুগবিচ্ছিন্ন, পশ্চাৎপদ। সন্তোষজনক হলো না আমাদের শিক্ষকদের খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি। কাজেই ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে এই, ইংরেজিতে একটি প্রবচন আছে যার বাংলাটা হবে এমনÑ তপ্ত কড়াই থেকে আগুনে পুড়ে যাওয়া। আমাদের আগে ছিল তপ্ত কড়াই, এখন আগুনের মধ্যে পড়ল পরীক্ষা পদ্ধতি।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার হালহকিত নিয়ে কিন্তু নানাবিদও প্রশ্ন উঠছে। আমরা মোটা দাগে বলতে পারি, শিক্ষাব্যবস্থা একটা দারুণ সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে দেশ ও জাতির জন্য অশনি সংকেত। শিক্ষামন্ত্রণলায় অনবরত নানাবিদও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে আর গিনিপিগ হচ্ছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এবং ফলাফলে নানা ধরনের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। একসময় কৃত্রিম উপায়ে ভালো ফলাফলের বিস্কোরণ ঘটানো হয়েছিল, এখন আবার আরেকটি পদ্ধতিতে ফলাফল সংকুচিত করা হলো। এর কোনোটিতেই মেধার মূল্যায়ন হয়নি।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ইংরেজি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার সংখ্যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। অর্থ্যাৎ ইংরেজিতে ভালো প্রশিক্ষণ হচ্ছে না সেটা বোঝা যায়। আবার বহু নির্বাচনি পদ্ধতি অংশে অকৃতকার্য হওয়ার সংখ্যা ভয়ংকর। বহু নির্বাচনি অংশে ভালো ফল করতে হলে সব সময় শিক্ষার্থীদের ব্যাপক পড়ালেখা করতে হয়, সেটাও হয়নি। সব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে একটা দারুণ সংকেট আছে তারই প্রমাণ হলো উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যতই আত্মতৃপ্তি বোধ করুন না কেন, আমরা কিন্তু দারুণভাবে শঙ্কিত এবং অনেকটা উঁচাটন দেশের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে পাসের এই হারকে আমি বিপর্যয় মনে করি না। কারণ আগে ছিল অনেক বেশি, এখন তার চেয়ে একটু কমেছে। আগেরটা ছিল কৃত্রিমভাবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভালো ফল বা ফলাফলের বিস্ফোরণ ঘটানোর একটা অবস্থা, এখন আমাদের সমালোচনার চাপে পড়ে এই ফল একটু সংকুচিত করা হয়েছে। মনে আছে, ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিভাগ থেকে যখন আমি এসএসসি পাস করলাম, তখন পাসের হার ছিল ২৮ ভাগ। তখন তো কেউ বলেনি ফল বিপর্যয় হয়েছে। এখন বিপর্যয় হচ্ছে যে, একসময় পাসের হার অনেকটা বাড়ানো হয়েছিল, এখন এখন একটু কমানো হলো। এটাকে আমি বিপর্যয় বলি না। বিপর্যয় দিকটা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা কি শিখল, কি শিখল না তার ওপরই নির্ভর করবে বিপর্যয় হলো কি হলো না।
পরীক্ষায় ভালো ফল ভালো শিক্ষার পরিচায়ক নয়। ভালো শিক্ষার পরিচয় বহন করবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গরিমা। সেই জ্ঞান-গরিমা তারা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে সেটাই আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় দেখা গেছে যে, জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ইংরেজি-বাংলায় অকৃতকার্য হয়েছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার দারুণ ক্রটি রয়ে গেছে। সুতরাং ফল বিপর্যয় তখনই মনে করব যখন শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গরিমার সীমাবদ্ধতা প্রকট হবে ।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যে সংকটে আছে তার থেকে উত্তরণের জন্য যথার্থ শিক্ষাবিদদের পরামর্শ দরকার। সরকারি শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নয়, যারা দলমত নির্বিশেষ, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে, শিক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, যারা সমাজের স্বীকৃতি এবং গৃহীত তাদের অভিমত নিতে হবে। তাদের অভিমতের প্রেক্ষাপটে যে সুপারিশমালা তৈরি হবে, সেটি যদি সরকার আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করে তাহলে শিক্ষাব্যবস্থার সংকট দূর হবে।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।