ফেলুদা যেভাবে হয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Image

কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস আজ। গত বছর আজকের দিনে কলকাতার একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রূপালি পর্দায় ৬০ বছরের বেশি অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সফল মঞ্চাভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, কবি ও এক্ষণ নামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন তিনি।

১৯ জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তার পরিবারের আদিবাড়ি ছিল বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় শিলাইদহের কাছে কয়া নামে একটি গ্রামে। তার পিতামহের সময় থেকে তারা কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন। কৃষ্ণনগরেই ছিল তার স্কুলের প্রাথমিক লেখাপড়া। পরে কাজের সুবাদে তার বাবা কলকাতায় চলে এলে পরবর্তীতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নেন কলকাতাতেই। অভিনয়ের প্রতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই।

এক সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, কৃষ্ণনগরে বেশ উন্নতমানের নাট্যচর্চ্চা হতো তার ছেলে বেলায়। তার বাবা সেখানে শৌখীন নাট্য দলে নাটক করতেন, বাড়িতেও কবিতা আবৃত্তি এবং নাটকের একটা আবহ ছিল। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘শৈশবকালে আমরাও বাড়িতে তক্তাপোষ দিয়ে মঞ্চ তৈরি করে, বিছানার চাদর দিয়ে পর্দা খাটিয়ে ভাই-বোন ও বন্ধু-বান্ধবরা মিলে ছোট ছোট নাটিকার অভিনয় করতাম। বাড়ির বড়রাও প্রচুর উৎসাহ দিতেন। ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ার সময় থেকেই আমার নাটকের নেশা প্রচুর বেড়ে গেল।’

স্কুলের মঞ্চে প্রথম অভিনয় করেছিলেন ইংরেজি একটি নাটক ‘স্লিপিং প্রিন্সেস’। যার জন্য পদক ও মেডেলও পেয়েছিলেন তিনি। কলেজে অনার্সে বাংলা নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির কুমার ভাদুড়ীর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল তার। তখন থেকেই অভিনয়কে জীবনের মূল লক্ষ্য করে নেবার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার নাট্যাভিনয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

তিনি বলেছিলেন, ‘বিএ ফাইনাল ক্লাসে পড়ার সময়ই আমি মনস্থির করে ফেলেছিলাম আমি অভিনয় করব, আর কিছু করব না।’ ১৯৫৯ সালে সত্যজিত রায়ের ‘অপুর সংসার’ সিনেমায় চলচ্চিত্রে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ। সত্যজিত রায়ের ১৪টি সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরিচালক সত্যজিত রায়ের সাথে তার একটা গভীর বন্ধন গড়ে উঠেছিল। সত্যজিত রায়কে নিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘মানিকদার সঙ্গে’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন। এছাড়া তিনি একটি ইংরেজি অনুবাদ ও করেন এবং ওই বইয়ের নাম ‘দা মাস্টার অ্যান্ড আই।’

সত্যজিত রায় যেমন সিনেমার খুঁটিনাটির ব্যাপারে খুবই পার্টিকুলার ছিলেন, তার সাথে কাজ করা অভিনেতাদেরও তিনি একইভাবে তৈরি করে নিতেন। তার ঘনিষ্ঠ ও তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লাইব্রেরিতে একটা পুরনো খাতা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন যেটি ছিল চারুলতা সিনেমার শুটিংয়ের সময়কার। ওই খাতায় রবীন্দ্রনাথের সময় যেধরনের হাতের লেখার চল ছিল, তা ফুটিয়ে তোলার জন্য সেখানে সাদা কাগজে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কীভাবে অসংখ্যবার সেধরনের লেখার অনুশীলন করেছিলেন তা দেখা যায়।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, এম এ পড়ার সময় সত্যজিত রায় তার প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ করার পর যখন দ্বিতীয় ভাগ ‘অপরাজিত’ করবেন বলে কিশোর অপুর চরিত্রের জন্য একজনকে খুঁজছিলেন। তখন সত্যজিত রায়ের পরিচিত একজন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে চিনতেন তিনি তাকে নিয়ে যান সত্যজিত রায়ের কাছে।

‘আমি তখন ওই কিশোর বয়সের অপুর পক্ষে বড়। আমাকে দেখা মাত্র তিনি বলেন- এহে আপনি তো বড্ড বড় হয়ে গেলেন। যাই হোক তার অনেক পরে যখন উনি তৃতীয় ভাগ অপুর সংসার করবেন বলে মনস্থির করেন যেখানে যুবক অপুকে দরকার তখন আমাকে খবর দেন। আমি যাই এবং আরো অনেক পরে জেনেছিলাম যে মোটামুটি আমাকে দেখার পর উনি ঠিক করেছিলেন তাহলে যুবক অপুর জন্য একজনকে পাওয়া যাবে এবং তিনি স্থির করেন তিনি তৃতীয় ভাগও করবেন।’

সত্যজিত রায় ছাড়াও মৃণাল সেন, তপন সিংহসহ বহু নামী পরিচালকের প্রায় দু’শয়েরমত সিনেমায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এর মধ্যে তার খুবই জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর মধ্যে আছে- মৃণাল সেনের ‘আকাশ-কুসুম’, তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, অজয় করের ‘অতল জলের আহ্বান’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘পরিণীতা’, আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়ের ‘তিন ভুবনের পারে’ ইত্যাদি।

অনেক সিনেমায় এক সাথে অভিনয় করেছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একসঙ্গে তাদের পর্দায় দেখা যাক বা না যাক বাঙালি সিনেমা প্রেমীদের মধ্যে চরম বিভক্তি ছিল তাদের প্রিয় নায়ককে তা নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের সিনেমাভক্তদের একদল মনে করতেন ‘জনতার মহানায়ক’ একজনই তিনি উত্তম কুমার। আর প্রতিপক্ষ দলের পরিষ্কার রায় ছিল বুদ্ধিজীবী মননের চলচ্চিত্রে ‘শেষ কথা’ একজনই তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বড় ও ছোট পর্দার নানা সিনেমায় তিনি কাজ করে গেছেন। সাম্প্রতিককালের বহু পরিচালকের সিনেমায় তার অভিনীত অনেক সিনেমা খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সত্যজিত রায়ের বিভিন্ন সিনেমার তিনি সফল নায়ক তো বটেই কিন্তু সত্যজিত রায়ের ‘ফেলুদা’ চরিত্রের সুবাদে মানুষের কাছে তার আরেক নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ফেলুদা’। সত্যজিত রায়ের পরিচালনায় ফেলুদা বা অন্যান্য চরিত্রে অভিনয়ের চেয়েও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনেক বেশি কাজ করেছিলেন অন্যান্য পরিচালকদের সিনেমায়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের প্রধান মধুজা মুখার্জী বলছিলেন, সৌমিত্র চ্যাটার্জীর একটা বিরল দক্ষতা ছিল একই সময়ে একই সাথে সত্যজিত রায়ের মত পরিচালক ও অন্য পরিচালকের সিনেমায় তিনি ভিন্ন ধরনের চরিত্র ধরতে পারতেন। মঞ্চ অভিনয় এবং নাট্য নির্দেশনাতেও দারুণ সফল ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, নাটক ছিল তার প্রথম প্রেম। তাই সিনেমার কাজে ব্যস্ত থাকার পরেও তিনি ছুটে যেতেন মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে। তিনি ১৯৬৩ সালে ‘তাপসী’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে নাট্যজীবনের শুরু করেছিলেন। তার এ জীবনের শুরু হয় কলকাতার স্টার থিয়েটারে। তিনি রূপালি পর্দার পাশাপাশি তার নাটকের প্রেমকে সজীব রাখতে অনেক পরিশ্রম করেছেন। শুটিং শেষ করে দৌড়েছেন মঞ্চে অভিনয় করতে।

তিনি বলেছিলেন, তখন চলচ্চিত্রে তিনি এত ব্যস্ত নায়ক যে থিয়েটারের জন্য সময় বের করা তার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। তার জন্য ‘অনেক কাঠখড় পোড়াতে’ হয়েছে তাকে। ‘থিয়েটারের জন্য আমার নেশাই বলুন বা ভালবাসাই বলুন, সেটা এত প্রবল ছিল যে সেই কষ্ট আমি খুবই সানন্দে বরণ করে নিয়েছিলা।’

কর্মজীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত তিনি মঞ্চ অভিনয় ছাড়েননি। নাটক ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রেম আর দ্বিতীয় প্রেম ছিল সাহিত্য। তিনি এবং নির্মল আচার্য ১৯৬১ সালে তৈরি করেছিলেন এক্ষণ নামে একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা। মননশীল পাঠকরা ওই পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন। পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন সত্যজিত রায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। তিনি সম্পাদনার কাজ করতেন লিখতেন আবার বিজ্ঞাপনও যোগাড় করার জন্য ছুটে বেড়াতেন সেই সময়ের মহাব্যস্ত নায়ক। পত্রিকার জন্য যেমন সিরিয়াস প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি তেমনই লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতার আর নাটকের বই।

অভিনয়ে তার অবদানের জন্য দেশি-বিদেশি অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ২০০৪ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মান, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন দুবার, সিনেমায় তার সারাজীবনের অবদানের জন্য ২০১২ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের সবোর্চ্চ চলচ্চিত্র খেতাব ‘দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননা।’

নাট্যশিল্পে তার অবদানের জন্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফরাসি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৯৯ সালে পান সম্মানজনক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি ‘কমান্ডার ডি এল অর্ডার দেস আর্টস এবং ডেস লেট্রেস।’ তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেতা যাকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়। ২০১৭ সালে তিনি ফরাসি সরকারের বেসামরিক সম্মাননা লিজিয়ন অফ অনারে ভূষিত হন।

ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্যাথরিন বার্জ তার জীবন নিয়ে তৈরি করেছিলেন তথ্যচিত্র ‘গাছ’। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসানের মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্র জগতের বিশাল সেই ‘গাছ’ বা মহীরুহের পতন ঘটল।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।