প্রাথমিকে হ-য-ব-র-ল

ডেস্ক রিপোর্ট : সোমবার মন্ত্রিসভায় প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণিতে সমাপনী আগের মতোই হবে বলে জানানোর ৬ দিন আগে চলতি বছর থেকেই এই পরীক্ষা হচ্ছে না বলে জানিয়েছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তফিজুর রহমান। এ নিয়ে আগে থেকেই নানামুখী বক্তব্য আসছিল মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর করার আলোচনা শুরুর পর থেকেই এ ক্ষেত্রে এক ধরনের হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে। পঞ্চমে সমাপনী হবে কিনা, প্রাথমিকের অবকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যসূচি এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে খোদ শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, দায়িত্বশীল মন্ত্রী যখন এই পরীক্ষা হবে না বলে জানান তখন সবাই সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিসভায় এটির বিপরীত ঘটালো। তারা বলেন, জাতীয় পর্যায়ের একটি পরীক্ষা, যেখানে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থী অংশ নেবে, সেই পরীক্ষা হবে কী হবে না তা নিয়ে দায়িত্বশীল মন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে কী ব্যক্তিগত অভিমত জানাতে পারেন? ওই সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলেছিলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই তো কথা বলি। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা তুলে দিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে কোনো নামে সমাপনী পরীক্ষা নেয়া হবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিষয়টি যখন মন্ত্রিসভায় উঠলো, তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কী কোনো আপত্তি তুলেছেন? নাকি মৌন সম্মতি দিয়েছেন?

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সমাপনী থাকবে কী থাকবে না সেটি সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা দুশ্চিন্তা ও দুর্ভোগে পড়েন। এতে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জেনে বুঝে মন্তব্য করলে সমস্যা সৃষ্টি হয় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক ও জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে স্কুলে ও কোচিং সেন্টারে নানা প্রকারের মডেল টেস্টে বুঁদ হয়ে থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ফলে যখন পরীক্ষা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া, শিক্ষার্থী, অভিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষামনস্ক সবাই স্বস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু না। মন্ত্রিসভা তা বাতিল করে। কারণ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে অবকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণসহ অনেক ধরনের কর্মকাণ্ড জড়িত। তাই পুরো বিষয়টি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আগের মতোই পঞ্চম শ্রেণীতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ও অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা অব্যাহত থাকবে।

এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে অভিভাবকদের মাঝে। সরকারের এসব পরিবর্তনগুলো ফল ভোগ করতে হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষাবিদরা বলছেন, পর্যাপ্ত প্রস্ততি ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করে রীতিমতো তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয়ভাবে সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার ফলে প্রাথমিকে ড্রপ আউট, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উৎসাহ, আগ্রহ বেড়েছে। এসব কারণেই সমাপনী পরীক্ষা বাতিল না করে রাখার পক্ষে মত আসে মন্ত্রিসভা থেকে। কেন্দ্রীয়ভাবে সমাপনী পরীক্ষা হলে কোচিং বাণিজ্য হবে এই বিষয়ে জানানো হয় মন্ত্রিসভায়। বৈঠকে আস্তে আস্তে এই পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার পক্ষে মত আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনটিউটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, স্নাতক ও বিএড ডিগ্রিধারী শিক্ষক নেই, কারিকুলাম প্রণয়ন হয়নি এবং নতুন কারিকুলামে পাঠ্যবইও শিক্ষার্থীরা পাবে না। তার পরও দেশের প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এমন ঘোষণা দেয়ার আগে এসব বিষয়ের সমাধান জরুরি ছিল। কিন্তু তা না করায় প্রাথমিক শিক্ষায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সব মিলিয়ে শুধু নামেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা হবে। এ সব বিষয় মাথায় নিয়েই মন্ত্রিসভা এখনই সমাপনী পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার পক্ষে মতামত দেয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ এমন ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, জনবল, ব্যবস্থাপনা- সবকিছুই নতুন করে সাজাতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে স্নাতক ও বিএড ডিগ্রিধারী শিক্ষক। কিন্তু প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীতকরণের জন্য বিশেষভাবে কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবীর বলেন, শিক্ষানীতির আলোকে আজ হোক, কাল হোক প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করতেই হবে। তবে এখন নামেমাত্র অষ্টম শ্রেণী করা হয়েছে। এটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে আরও ৪-৫ বছর সময় লাগবে। কারণ এর জন্য নলেজ বেইজড সিলেবাস (আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সূচি) তৈরি করতে হবে, প্রণয়ন করতে হবে নতুন পাঠ্যক্রম। নিয়োগ দিতে হবে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক। বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষক দিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পাঠদান সম্ভব নয়।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।