বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার গত ১৫ মার্চ রাজধানীর আজিমপুর থেকে উত্তরা যেতে রাইড শেয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘উবার’-এ মোটরসাইকেল কল করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইক নিয়ে হাজির হন চালক। চলতে শুরু করলে বাশার হাওলাদারের মনে হয় চালক তাঁর পরিচিত। তবে মাস্ক থাকায় ঠিক চিনতে পারছিলেন না। পরে কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি চালককে চিনতে পেরে হতবাক হয়ে যান।
কারণ, চালক সুরমান আলী তাঁরই সংগঠনের একজন সদস্য। ছিলেন রাজধানীর নীলক্ষেত হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। চাকরি হারিয়ে দুর্মূল্যের বাজারে পরিবারের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে বাধ্য হয়ে নেমেছেন পথে।
ভরা চৈত্রের আগুনতপ্ত দুপুরে রাজপথে বাইক চালিয়ে ঘর্মাক্ত সুরমান আলীকে নিয়ে পরে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন আবুল বাশার– ‘খোদ রাজধানীর একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভাড়ায় বাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।’ মুহূর্তে শিক্ষকদের ফেসবুক গ্রুপগুলোতে ভাইরাল হয় সেই পোস্ট। ওই দিনই সমকালের পক্ষ থেকে ফোন করা হয় সুরমান আলীকে। তিনি নিজের বাইক নিয়ে আসেন তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে। কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
সুরমান আলী জানান, ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বেনামি এক অভিযোগের ভিত্তিতে নীলক্ষেত হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি তাঁকে ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর প্রধান শিক্ষক পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে। ২০২২ সালের ৯ মে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত অভিযোগকারী পত্রদাতাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের আরবিট্রেশন বোর্ডে তাঁর কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি সেই নির্দেশ তো মানেইনি, উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।
অশ্রুসিক্ত সুরমান আলী জানান, ২৮ মাস ধরে তাঁর চাকরি নেই। দুই সন্তান, স্ত্রী, মাসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম তিনি। ছেলে নটর ডেম কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে আর মেয়ে মহল্লার একটি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। চাকরি ফিরে পেতে গত দুই বছর শিক্ষা বোর্ড আর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি হয়রান। মামলা চালাতে গিয়ে সব সঞ্চয় ভেঙেছেন।
পরিবারের সবার মুখে আহার জোগাতে বাধ্য হয়ে এখন ‘উবার’ আর ‘পাঠাও’ চালাচ্ছেন।
এক পর্যায়ে অঝোরে কেঁদে ফেললেন সুরমান আলী। জানালেন, তাঁর বয়স এখন ৫৪ বছর। তিনি অসুস্থ। ফলে দীর্ঘক্ষণ বাইক চালাতে পারেন না। দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা চালিয়ে খুব যে আয় হয়, তেমনও নয়।
সুরমান আলীর গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগর থানায়। এখন রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানার মানিকদীতে পরিবারসহ থাকেন। দীর্ঘ ২২ বছরের শিক্ষকতা জীবন তাঁর। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন নীলক্ষেত হাই স্কুলে।
সুরমান আলী জানান, অন্যায়ভাবে তাঁকে চাকরিচ্যুত করার ঘটটনায় প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক তাঁর পক্ষে লিখিতভাবে সমর্থন জানান। এখন সেই শিক্ষকদেরও প্রতিষ্ঠান নানাভাবে হয়রানি করছে ও চাকরিচ্যুতির হুমকি দিচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, শুধু তাঁকে নয়; আগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফাকেও একইভাবে ম্যানেজিং কমিটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই শিক্ষক সাময়িক বরখাস্তই ছিলেন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে জানা যায়, সুরমান আলীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, অর্থ আত্মসাৎ ও একজন শিক্ষকের এমপিওভুক্তিতে জালিয়াতির তিন অভিযোগ এনে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে সুরমান আলী ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের আপিল অ্যান্ড আরবিট্রেশন কমিটির কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে কমিটি একটি অভিযোগেরও প্রমাণ পায়নি। এ কারণে স্কুল ম্যানেজিং কমিটিকে বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধসহ সুরমান আলীকে প্রধান শিক্ষক পদে পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর এ নির্দেশ স্কুলের সভাপতিকে লিখিতভাবে জানান শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক আজাদ হোসেন চৌধুরী। তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারি এ নির্দেশকে পাত্তা দেয়নি।
নীলক্ষেত হাই স্কুলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিতে নির্মিত। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখানে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মনোনয়ন দেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইন ও বিধানে পরিচালিত হয়। বর্তমান সভাপতি ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রশীদ জানান, সুরমান আলীর বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। আদালত বললে তিনি চাকরি ফেরত পাবেন। স্কুলের নিজস্ব তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে জানিয়ে তিনি এ বিষয়ে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশীদ বলেন, সুরমান আলী উবার চালান, সেটি জানা ছিল না। এটি খুব বেদনাদায়ক। আমাদের সমাজে শিক্ষকদের এত বেশি টাকা-পয়সা থাকে না। তিনি বলেন, কিছু অভিযোগে সুরমান আলী চাকরিচ্যুত, যা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। রায় পেলে সেই অনুসারে ব্যবস্থা হবে।