পাঠ্যবইয়ে যা নেই, তা নিয়ে হইচই

Image

নিজস্ব প্রতিবেদক,২৮ জানুয়ারী ২০২৩:

চলতি বছরে শিক্ষার্থীরা বই হাতে পাওয়ার পর থেকে বইয়ের ভুলত্রুটি নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। নতুন-পুরোনো দুই সিলেবাসের প্রায় সব শ্রেণির পাঠ্যবইয়েই রয়েছে অসংখ্য তথ্যগত ভুল। এসব ভুল যেমন রয়েছে, তেমনি সুযোগ নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ নেই এমন সব স্পর্শকাতর তথ্য।

আরো পড়ুন: ভুল বই ও সিলেবাস বাতিল করতে হবে: চরমোনাই পীর

মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য বা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আর এতেই সব মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। বিবৃতি, আলোচনা বা সমাবেশ করে এর বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে। অথচ যারা বলছেন তারা কেউই বই খুলে দেখছেন না। গুজবে ভর করে কথা বলেই যাচ্ছেন। যেন কান চিল নিয়েছে শুনে কানের খোঁজে চিলের পেছনে ছুড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু হাত দিয়ে কান ধরে দেখছে না কানটা আসলেই চিলে নিয়েছে কি না।

ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যা এসব তথ্য হরহামেশায় ছড়ানো হচ্ছে। এসব নিয়ে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার ওয়াজ মাহফিল, রাজনৈতিক সভা, সেমিনারসহ সর্বত্রই আলোচনা রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তনের দাবিও তুলেছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। বইয়ে কিছু তথ্যগত ভুল থাকলেও যেসব তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, পাঠ্যপুস্তক ঘেঁটে সেটির সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এ বছর তিন শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম শুরু হওয়ায় দুই ধরনের পাঠ্যবই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে নতুন কারিকুলামের বই। বাকি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে পুরোনো কারিকুলামের বই। পুরোনো কারিকুলামের নবম-দশম শ্রেণির তিনটি বইয়ে বেশ কিছু ভুল সংশোধন করে দিয়েছে এনসিটিবি। বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ে এই ভুলগুলো হয়েছিল। নতুন কারিকুলামের বইয়ে ভুলের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাদা দুটি কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা রয়েছে, ‘নতুন বছরের পাঠ্যবইয়ে মুসলিম রাষ্ট্রে বিধর্মীদের শাসনব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে’। ইসলামের বিভিন্ন খলিফার জীবনী বাদ দিয়ে সবাইকে নাস্তিক বানানোর চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে তাদের পরামর্শেই নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় প্রণয়ন করা হয়েছে, এমন তথ্যও ছড়ানো হয়েছে।

সামাজিক মাধ্যম ঘেঁটে দেখা গেছে, ব্যক্তিগত ফেইক অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি ফেসবুকের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি তথ্যের গ্রুপ, শিক্ষাবর্ষভিত্তিক গ্রুপ, বিভিন্ন ইসলামি বক্তার সমর্থক গ্রুপ, অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে বিভ্রান্তিকর এসব তথ্য শেয়ার করা হয়েছে। এসব পোস্টের নিচে মন্তব্য করেছেন হাজার হাজার মানুষ। সহজেই বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে ফেসবুকভিত্তিক এসব গ্রুপকে টার্গেট করে এ তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।

তবে পাঠ্যবইয়ে প্রতিটি শ্রেণিতেই মহানবী (সা.) ও ইসলামের খলিফাদের জীবনী বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় রয়েছে। তবে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত যেসব গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধ পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সেগুলো ২০১৭ সালের আগে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত ছিল। এগুলো বর্তমান পাঠ্যবইয়ে নেই। ২০১৭ সালেই এগুলো পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তবু এই আলোচনা নতুন করে ছড়ানো হচ্ছে।

পাঠ্যবইয়ে যেসব বিষয় নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিবর্তনবাদ। বলা হচ্ছে ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ্যবইয়ে বিবর্তনবাদের বর্ণনায় মানুষ বানর থেকে তৈরি হয়েছে। বাস্তবে ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ্যবই ঘেঁটে দেখা যায় তথ্যটি সঠিক নয়। বইটির ২৪ পৃষ্ঠার ৮ লাইনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ‘বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি’।

ছড়িয়ে পড়া ফেসবুক পোস্টগুলোতে দাবি করা হয়েছে, দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই থেকে মহানবী (সা.)-এর জীবনী শীর্ষক ‘সবাই মিলে করি কাজ’ প্রবন্ধটি বাদ দেয়া হয়েছে। বাস্তবে প্রবন্ধটি বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠায় রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই থেকে খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-এর জীবনী বাদ দেয়া হয়েছে। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বিষয়টি পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়া হয়নি। বরং তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৯ পৃষ্ঠায় খলিফা আবু বকর (রা.) নামে তার জীবনী নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি খুঁজে পাওয়া যায়। চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর জীবনী বাদ দেয়া হয়েছে বলে তথ্য ছড়ানো হয়েছে। সত্য হচ্ছে, চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৭ পৃষ্ঠায় খলিফা হজরত ওমর (রা)-এর জীবনী নিয়ে লেখা রয়েছে।

পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে ‘বিদায় হজ’ প্রবন্ধটি বাদ দেয়া হয়েছে বলেও প্রচার করা হয়েছে। তবে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৫তম পৃষ্ঠায় ‘বিদায় হজ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি খুঁজে পাওয়া যায়। একই শ্রেণিতে বাংলা বইয়ে ‘বই’ নামের কোরআনবিরোধী একটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। তবে এনসিটিবি থেকে শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে এ রকম কোনো কবিতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বলা হচ্ছে, ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘লাল গরু’ নামের কথিত হিন্দুত্ববাদী প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। তবে

ষষ্ঠ শ্রেণির বর্তমান পাঠ্যবইয়ে এই নামের কোনো প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘লালো’ নামের একটি গল্প আনা হয়েছে, যেখানে কালীপূজা এবং পাঠা বলির গল্প রয়েছে। বাস্তবে বইয়ে এই গল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে হিন্দুদের রামায়ণ নামের গ্রন্থ সংযুক্ত করার তথ্যও প্রচলিত রয়েছে। তবে পুরোনো শিক্ষাক্রমের অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়ে এই নামের কোনো গল্প নেই।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, পাঠ্যবইয়ে ভুলত্রুটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপেই ভুল তথ্য শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। তবে এ বছর পাঠ্যবই নিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সমালোচনা করছেন। এই সমালোচনা যদি শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্য হয় তবে বিষয়টি ইতিবাচক। কিন্তু আমরা দেখছি পাঠ্যপুস্তকে ভুলের বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ রাজনৈতিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান শিক্ষাবার্তাকে বলেন, পাঠ্যপুস্তককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা হচ্ছে। বইয়ে কিছু ভুল রয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি কিছু তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে যার কোনো ভিত্তি নেই। এটি শিক্ষার্থীদের বিব্রত করার চেষ্টা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থা বিপন্ন করতেই এটি করা হচ্ছে।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।