জাবি প্রতিনিধি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ব্যাক্তিদের কথা বিবেচনা করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের বয়স দুই বছর বৃদ্ধি করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। অর্থের উৎস বের না করে বিশেষ ব্যাক্তিদের সুবিধা দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বর্ধিত বয়সের বেতন ও অন্যান্য ভাতার বিষয়ে সরকার আর্থিক অনুমোদন না দেওয়ায় এসব বেতন ও ভাতা বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল হতে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বাৎসরিক আর্থিক ক্ষতির পরিমান ও ঘাটতি বাজেটের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আগামী ২৫ জুন বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের ৩৫তম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এতে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের ১৫৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকার সংশোধিত বাজেট এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরের ১৯৩ কোটি ৫২ লাখ টাকার মূল বাজেট উপস্থাপন করা হবে। বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও বিধিমালা লঙ্ঘন করে অর্থ ব্যয়ের কারণে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে ঘাটতি হয়েছে ১৩ কোটি ৩১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমান ছিল ৬ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা।
এদিকে গত ১৮ মে ইউজিসির পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে অবসরের বয়স ২ বছর বৃদ্ধি করায় তা বাতিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বর্ধিত বয়সের অনুমোদন সরকারও দেয়নি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টিকে সিন্ডিকেট এবং সিনেট সভার আলোচ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত না করায় এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জাবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, তারা ৬০ বছরেই অবসরে যেতে চান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যাক্তির অভিযোগ, দুই কর্মকর্তাকে বিশেষ সুবিধা দিতে ইউজিসির নির্দেশনা মানতেও টালবাহানা শুরু করেছে প্রশাসন। তারা বলেন, দুই-একজন কর্মকর্তার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাই না। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে আদালতে যেতে বাধ্য হব।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার কোন অনুমোদন না দেওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগার হতেই পরিশোধ করতে হচ্ছে। যা প্রতি বছর অসম্ভব। তবে প্রশাসনের উচিৎ সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য বিষয়টিকে সিনেটে উপস্থাপন করা। তা না হলে আর্থিক ক্ষতি দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
এ প্রসঙ্গে সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি অধ্যাপক মো. খবির উদ্দিন বলেন, ‘জাবি’র ঘাটতি বাজেট দিন দিন বাড়ছে। সরকার কোন অনুমোদন দেয়নি, তাই এটি কার্যকর রাখা উচিৎ হবে না। এতে আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি পাবে।’
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২২ মার্চ ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম প্রশাসনের প্রথম সিন্ডিকেট সভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি হতে অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বছরের ৩ জুন অনুষ্ঠিত বিশেষ সিনেট অধিবেশনে তা পাসও হয় এবং জুন মাস হতেই প্রশাসন তা কার্যকর করে।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরীর বয়সসীমা ছিল ৬০ বছর। সে হিসাবে ২০১৪ সালের জুনে ১৭ জন ও ২০১৫ সালের জুনে ২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই বছর বৃদ্ধি করায় তারা ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের জুনে অবসরে যাবেন।
বর্ধিত বয়সসীমা অনুযায়ী ১৭ জন দুই বছর এবং ২২ জন এক বছর চাকুরি করেছেন। এ হিসেবে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে বর্ধিত সময়ের বেতন ও অন্যান্য ভাতা নিজস্ব তহবিল হতে পরিশোধ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। নতুন পে-স্কেল কার্যকর হওয়ায় পরের অর্থ বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতির পরিমান আরোও বাড়বে।
আর্থিক ক্ষতির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল খায়ের বলেন, ভিসি মহোদয় বিষয়টি অন্য ভিসিদের সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করছেন।
এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত কম্পট্রোলার মো. মোসানুল কবীর বলেন, সরকার অনুমোদন দেয়নি। বর্ধিত বয়স বাতিল করতে ইউজিসি একটি নির্দেশনা দিয়েছে। তবে প্রশাসনিকভাবে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেনকে ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেন নি।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। গেজেটে বলা হয়- অধ্যাদেশ, রাষ্ট্রপতির আদেশ অথবা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন দলিলে যা কিছুই থাকুক না কেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ৬৫ বছরেই অবসর গ্রহণ করতে হবে।
কিন্তু জাবি প্রশাসন সংসদের এই আইনকে তোয়াক্কা না করে বিশেষ ব্যক্তিদের সামনে রেখে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর করে। এতে সরকার কোন অনুমোদন দেয়নি। পরে গত বছরের ৩১ জুলাই সিনেটের জরুরি সভায় আগের সিদ্ধান্তটি বাতিল করে ৬৫ বছর পুনর্বহাল করা হয়।
৬৫ বছর অনুযায়ী ১০জন শিক্ষক ২০১৪ সালেই অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও দুই বছর বৃদ্ধি করায় তারা ২০১৬ সালে অবসরে যান। ওই ১০ শিক্ষককে বর্ধিত সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ায় প্রশাসন ব্যপক সমালোচনা মুখে পড়ে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭০ লক্ষাধিক টাকা।