ডেস্ক,৫ মে ২০২৩: একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সাবেক অধ্যক্ষ থেকে বর্তমান অধ্যক্ষ এবং গভর্নিং বডির সভাপতির বিরুদ্ধেও সরকারি বিধিবিধান না মানার একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে গভর্নিং বডির সদস্যদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ১৬২ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ উঠেছে।
আরো পড়ুন: নিবন্ধন সনদ জাল করে শিক্ষকতা, শিক্ষিকার এমপিও বাতিল
জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ‘আপনি নেগেটিভ নিউজগুলো করেন কেন বলেন দেখি। যখন নেগেটিভ নিউজ আসে তখনই আমাকে ফোন দেন। এর আগেও আমাকে দুইবার নেগেটিভ নিউজের জন্য ফোন দিয়েছেন। আমি জানি আপনি কী বলবেন। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি। আমি ১৬২ জনকে কেন ভর্তি করাবো। আমি আসলাম কাল।’
২০১৯ সালে আপনি ভর্তি করিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের ঘটনা এখন কেন নিয়ে আসছেন? যারা নিয়ে আসছে (অভিযোগ করেছে) তাদের কাছে যান।’
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগে অনিয়ম
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের অধ্যক্ষ নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত দুই দফায় দুই জন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বের হতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। বরং আর্থিক দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম এমন পর্যায়ে পৌঁছে, যাতে বিশৃঙ্খলা আরও বেশি সৃষ্টি হয়েছে কলেজটিতে। এখন শিক্ষকরা দাবি করছেন—কলেজের বাইরে থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ করা যাবে না। বর্তমান কমিটির সভাপতি এবং অধ্যক্ষ দুই জনই সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকার পরও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ নিয়ে কলেজটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি
২০১৮ সালে প্রায় ১ এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করা হয়। ২০১৯ সালে অধ্যক্ষের স্বাক্ষর না নিয়ে ৪৪৩ জন শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করায় গভর্নিং বডি। এই অভিযোগে একজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় মন্ত্রণালয়। তবে কমিটির কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। একই বছর বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকাকালে প্রথম শ্রেণিতে ১৬২ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। গভর্নিং বডির অনুগত থাকায় ওই সময় তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাছাড়া গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যদের বিরুদ্ধে কখনও কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি মন্ত্রণালয় কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর।
গত ১৮ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা একটি আবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে চার জন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দায়িত্ব পালন করেন। এরমধ্যে কেকা রায় চৌধুরী ১৬২ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করান। কিন্তু ভর্তি ফরমে স্বাক্ষর না নিয়ে গভর্নিং বডি নিজ দায়িত্বে ৪৪৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে দায় চাপিয়েছে ৭৫ দিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষর দায়িত্ব পালন করা হাসিনা বেগমের ওপর।
২০২০ সালে আসন সংখ্যার অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তির অভিযোগ ওঠে প্রেষণে থাকা অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়ার বিরুদ্ধে। তবে তিনি জানান গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্বেই ভর্তি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, অভিযোগ রয়েছে ভিকারুননিসায় অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় টাকার বিনিময়ে। এই ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্বে থাকেন গভর্নিং বডির সভাপতি।
শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ প্রসঙ্গে ওই সময়ের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, প্রথম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে ১০ লাখ টাকা লাগে ভিকারুননিসায়। সে কারণে আমরা প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে লটারি সিস্টেম চালু করেছি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রি আত্মহত্যার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের দিন ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর এই তথ্য জানিয়েছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ।
অবৈধভাবে উপাধ্যক্ষ নিয়োগের চেষ্টা
২০১৯ সালে সালে অবৈধভাবে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগের চেষ্টা করা হলে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ওই অভিযোগের পর অধ্যক্ষ নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালে অবৈধভাবে উপাধ্যক্ষ নিয়োগের চেষ্টা চালানো হয়। তাতে ব্যর্থ হয়ে অবৈধভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগে খাতা টেম্পারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই নিয়োগও বন্ধ হয়ে যায়।
৬৯ জন শিক্ষক কর্মচারী-নিয়োগ
২০২১ সালে প্রথম অ্যাডহক কমিটি নিয়োগ দেওয়া হয় ৫ ডিসেম্বর। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার খলিলুর রহমানকে সভাপতি, অধ্যক্ষ কামরুননাহারকে সদস্য সচিব, নন-এমপিও শিক্ষক ড. ফারহানা খানম এবং অভিভাবক প্রতিনিধি ও আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খানকে সদস্য করে চার সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। ছয় মাস মেয়াদের এই কমিটি অনুমোদন করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। এই মেয়াদে গভর্নিং বডির নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে আবারও একই কমিটির অনুমোদন চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠান থেকে।
দ্বিতীয় মেয়াদেও অ্যাডহক কমিটি নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়। অ্যাডহক কমিটির মেয়াদের মধ্যে ২০২২ সালে নিয়োগ দেওয়া হয় শাখা প্রধান এবং ৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারী। যখন কমিটির কোনও বৈধতাই ছিল না সেই অতিরিক্ত সময় নিয়োগ দেওয়া হয় আরও ১৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী। মোট ৬৯ জন শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দেয় অ্যাডহক কমিটি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরে লিখিত অভিযোগ করে তদন্ত দাবি করেছেন একজন অভিভাবক।
প্রতিষ্ঠানটিতে ৬৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের কথা এর আগে স্বীকার করেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি প্রশাসন ক্যাডারের অতিরিক্ত সচিব ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার খলিলুর রহমান (বর্তমানে ভূমি সচিব)। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অভিযোগ করলে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা হবে কমিটির বৈঠকে।’ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভালো কিছু করতেও বেগ পেতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।
অ্যাডহক কমিটি এভাবে গণনিয়োগ দিতে পারে কিনা জানতে চাইলে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অ্যাডহক কমিটি কোনও নিয়োগই দিতে পারে না, বরখাস্তও করতে পারে না।’
এদিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিযুক্ত শিক্ষিকা ফাতেমা জোহরা হকের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তির পর আদালত তাকে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগদান করানোর নির্দেশ দিলেও অ্যাডহক কমিটি তাকে যোগদান করতে দেয়নি। অ্যাডহক কমিটি ওই শিক্ষককে যোগদান করাতে পারবে না বলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানের বাইরে রেখেছে। অথচ ওই অ্যাডহক কমিটি ৬৯ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছে। শাখা প্রধান নিয়েছে কোনও নিয়ম না মেনেই।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন