অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা: সাহসী পদক্ষেপ, চ্যালেঞ্জও বেশি

সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে প্রাথমিকের স্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা সিদ্ধান্ততে সাহসী পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছেন শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক ও শিক্ষাবিদরা।  একই সঙ্গে তারা এও বলছেন, বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জও কম নয়।  একারণে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সঠিক ও যৌক্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রমের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে ‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এবং বাস্তবতা’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে  এই আহ্বান জানান।  .

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এবং বাস্তবতা শীর্ষক জাতীয় সেমিনার.

প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের উপস্থিতিতে শিক্ষাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।  ‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা’ বাস্তবায়নের জন্য করণীয় বিষয়গুলোকে ১১টি অংশে ভাগ করে আলোচনা করেন তিনি।

প্রবন্ধের প্রথমাংশে ড. ছিদ্দিকুর রহমান  দেখান, পদক্ষেপটি বাস্তবায়ন করতে হলে রাষ্ট্রের করণীয় কাজের মধ্যে অভিন্ন, অবৈতনিক, সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মৌলিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে নৈতিক বিকাশ, টেকসই সাক্ষরতা অর্জন, জীবনদক্ষতা অর্জন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে। শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও বিস্তরণ বিষয়ে করণীয় কী—তা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, অতিদ্রুত শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কমিটি গঠন, এনসিটিবি-এর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় কমিটি কর্তৃক শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষাক্রম বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ড. ছিদ্দিকুর রহমান  বলেন, শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণ, শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণয়ন ও বিতরণ এবং শিক্ষা উপকরণ ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। এই কার্যক্রমকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে গেলে ৭টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন তিনি।সেগুলো হলো-শিক্ষাক্রম,শিখণ-সামগ্রী প্রণয়ন, শিক্ষক, শিক্ষক-শিক্ষা, অবকাঠামো, প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস এবং অর্থায়ন। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে পারলে সফল হওয়া সম্ভব।

প্রবন্ধের শেষে ড. ছিদ্দিকুর রহমান এই কার্যক্রমকে সফল করতে আশুকরণীয় হিসেবে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।তার মধ্যে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কমিটি গঠনকে অতি জরুরি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি গঠন,বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা,অভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষাসহ সামগ্রিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, স্কুল ম্যাপিং কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ২০ হাজার স্কুলে সম্প্রসারিত প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালন, পিটিআইসমূহকে প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষা কলেজে উন্নয়ন, প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষা কলেজে জনবল পদায়ন, প্রাথমিক শিক্ষক কলেজের শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস এবং সম্প্রসারিত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ।

প্রবন্ধ উপস্থাপন শেষে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের অভিমত তুলে ধরেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খান ৫ম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে, এটা ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু ৫ম শ্রেণির পরীক্ষা (পিইসি) বাতিল করলে অনেক সমস্যা হবে। তিনি বলেন, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাটি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটি বাতিল হলে শিক্ষার্থীরা কেমন পড়াশোনা করছে, তাদের মেধার অগ্রগতি কেমন তা বোঝা যাবে না। তাই ‘ক্লাস বেস অ্যাসেসমেন্ট’ না হওয়া পর্যন্ত ৫ম ও অষ্টম শ্রেণিতে এ দু’টি পরীক্ষা থাকা জরুরি।  এছাড়া, প্রাথমিকের স্তর অষ্টম শ্রেণি পর‌্যন্ত করলেই হবে না। এর চ্যালেঞ্জও অনেক মন্তব্য করে তিনি বলেন,চ্যালেঞ্জগুলো ভালোভাবে মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনায় জায়গা নেই, খেলার মাঠ নেই, ভবন নেই। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করলে তাদের আরও জায়গা লাগবে।এগুলো সময়মতো না দিতে পারলে সমস্যায় পড়তে হবে। কেননা, এতদিন যারা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নিয়েছেন এখন তারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নেবেন। তাই শিক্ষক, শিক্ষা অফিসারদের পুনরায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তবে নজরুল ইসলাম খানের মন্তব্যের বিরোধিতা করে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, ‘এ বছর থেকেই পিইসি তুলে দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার জন্য ভিন্ন কোনও উপায় হতে পারে। এর জন্য ভাষাজ্ঞান এবং গণিতের ওপর তাদের পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে।

বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, ‘অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা থেকে শিশুদের মুক্তি দিতে হবে। ক্লাস, কোচিং, প্রাইভেটে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে অভিভাবক-শিক্ষার্থী সবাই ক্লান্ত। এ অবস্থা থেকে তাদের রেহাই দিতে হবে।

প্রাইভেটে, কোচিংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পেছনে বইয়ের জটিলতাকে দায়ী করলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর। তিনি বলেন, ‘বইয়ের সবকিছু সহজ ভাষায় হওয়া উচিৎ। শিক্ষার্থীরা যদি বই পড়ামাত্র বিষয়বস্তু বুঝতে পারে তাহলে শিক্ষার্থীর কোচিংয়ের যাওয়ার প্রশ্নই আসতো না। আমাদের পাঠ্যবই সহজ সাবলীল করতে হবে।’

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জার্নির সহযোগিতায় সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন, জার্নির চেয়ারম্যান ও শিক্ষাবিদ ড.খন্দকার বজলুল হক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব হুমায়ুন খালিদ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মুস্তফা কামাল, শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান প্রমুখ।

এ বছর থেকেই পিইসি পরীক্ষা বাতিল হবে কিনা জানতে চাইলে সেমিনারে প্রধান অতিথি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিক সমাপনী একটি মূল্যায়ন পরীক্ষা। অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যেভাবে বার্ষিক পরীক্ষা দেয় সেভাবেই এ পরীক্ষাটি দেবে। আমরা চাই চলতি বছর থেকেই এ পরীক্ষাটি বাতিল হোক।  তিনি আরও বলেন,‘পিইসি পরীক্ষার প্রচলন মন্ত্রিসভা থেকে করা হয়েছিল এবং এটা বাতিল বা অন্য যা কিছু হোক, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেখান থেকেই আসবে।

এর আগে আরও বক্তব্য রাখেন, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ উম্মে সালমা বেগম, সূত্রাপুর থানা শিক্ষা অফিসার মঈনুল ইসলাম, নবাবপুর থানা শিক্ষা অফিসার পাপিয়া সুলতানা প্রমুখ।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।