সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা শুরু হচ্ছে আজ শুক্রবার (২০ অক্টোবর) থেকে। যদিও দেবী আসার ঘণ্টা বেজেছে মহালয়ার দিন (১৪ অক্টোবর) থেকেই। সনাতন ধর্ম মতে, যা কিছু দুঃখ-কষ্টের বিষয়, যেমন- বাধাবিঘ্ন, ভয়, দুঃখ-শোক, জ্বালা-যন্ত্রণা এসব থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন দেবী দুর্গা। শাস্ত্রকাররা দুর্গা নামের অর্থ করেছেন—দুঃখের মধ্য দিয়ে যাকে লাভ করা যায়, তিনিই দুর্গা। দেবী দুঃখ দিয়ে মানুষের সহ্য ক্ষমতা পরীক্ষা করেন। তখন মানুষ অস্থির না হয়ে তাকে ডাকলেই তিনি সবার কষ্ট দূর করেন। এ বছর ভক্তদের কষ্ট দূর করতে দেবী দুর্গা আসবেন ঘোড়ায় চড়ে, আর দশমীর দিন বিদায় নেবেন একই বাহনে।
হিন্দু পুরাণ মতে, দুর্গাপূজার সঠিক সময় বসন্তকাল। কিন্তু বিপাকে পড়ে রামচন্দ্র, রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি, সে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শরতেই দেবীকে অসময়ে জাগিয়ে পূজা করেন। সেই থেকে অকালবোধন হওয়া সত্ত্বেও শরৎকালেই দুর্গাপূজার প্রচলন হয়ে যায়।
শুক্রবার সকাল ৯টা ৫৮ মিনিটে কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজার মাধ্যমে শুরু হবে এবারের দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। এদিন ষষ্ঠী, সায়ংকালে দুর্গাদেবীর বোধন, আমন্ত্রণ এবং অধিবাস হবে।
বোধন মানে জাগ্রত করা বা জাগানো। বোধন হয় বেল গাছের তলায়। দেবতারাও বেল গাছের তলায় বোধন করেছিলেন। এ গাছের অন্য নাম শ্রীবৃক্ষ। শ্রী অর্থ সম্পদ বা সৌন্দর্য। তাই পুরোহিতরা সম্পদ বা সৌন্দর্য বা সংসারের উন্নতির জন্য, জ্ঞান-ভক্তি লাভের জন্য বেল গাছের মূলে দুর্গাপূজার বোধন করেন। বোধনে ঘট স্থাপন করা হয়। ঘট হলো হৃদয়ের প্রতীক। ঘটের জলে যেমন প্রতিবিম্ব পড়ে, সে রকম ভক্তের হৃদয়েও মায়ের ভাব বা স্বরূপের ধারণা হয়। সেই ধারণা অনুযায়ী প্রতিমা তৈরি হয়।
এবার দেবী দুর্গা আসবেন ঘোড়ায় চড়ে, আর দশমীর দিন বিদায় নেবেন এই একই বাহনে এবার দেবী দুর্গা আসবেন ঘোড়ায় চড়ে, আর দশমীর দিন বিদায় নেবেন এই একই বাহনে
মহালয়াতেই দেবীর আগমনের ঘণ্টা বাজে, আর বিজয়া দশমী দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানোর দিন। এই দিনটি শেষ হয় মহা-আরতির মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। আগামী শনিবার (২১ অক্টোবর) মহাসপ্তমী, রবিবার (২২ অক্টোবর) অষ্টমী, সোমবার (২৩ অক্টোবর ) মহানবমী এবং মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) দশমীর মাধ্যমে বিদায় নেবেন দুর্গা দেবী।
ষষ্ঠী পূজার আনুষ্ঠানিকতা প্রসঙ্গে রমনা কালী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হরি চাঁদ চক্রবর্তী জানান, ষষ্ঠী পূজায় বিল্ব বৃক্ষের নিচে মাকে ষষ্ঠাধী কল্পারম্ভ, ষষ্ঠীবিহিত পূজা করা হয়। এর মাধ্যমে মাকে মন্দিরের আঙ্গিনায় স্থাপন করা হয়। পরদিন বিল্ব বৃক্ষের নিচে মাকে স্নান করিয়ে মন্দিরে স্থাপন করা হবে।
ষষ্ঠী পূজা সম্পন্নের মাধ্যমে দুর্গাপূজা শুরু হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা—মা, তুমি বিশ্বের সব জীবের শান্তি দাও। সবাইকে তুমি ভালো রাখো, সুস্থ রাখো।’
মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা জানান, দুর্গোৎসবের অষ্টমীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। ষষ্ঠী পূজার দিন অসহায় মানুষের মধ্যে কমিটির পক্ষ থেকে বস্ত্র বিতরণ ও রক্তদান কর্মসূচি রয়েছে। মহা অষ্টমীতে জেলখানায় খাবার পাঠানো হবে।
শুক্রবার মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব শুরু হচ্ছে। বিজয়া দশমীর দিন মঙ্গলবার বিকাল তিনটার পর থেকে প্রতিমা বিসর্জনের কথা বলা হয়েছে। মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির নেতৃত্বে পলাশীর মোড় থেকে বিজয়া শোভাযাত্রা বের হয়ে সদরঘাটের ওয়াইজ ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হবে।
এদিকে, দুর্গাপূজাকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে মণ্ডপে মণ্ডপে। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির, জগন্নাথ হল, কলাবাগান মাঠ, খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণ, বনানী মাঠ, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বাড্ডাসহ রাজধানীর সবকটি পূজামণ্ডপের কাজ পুরোদমে চলছে। ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় আলোকসজ্জার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু মণ্ডপের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের দেওয়া তথ্য মতে, গত বছর সারা দেশে দুর্গাপূজায় মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১৬৮টি। এবার এখন পর্যন্ত এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৪০৮টি। ঢাকা মহানগরে পূজামণ্ডপের সংখ্যা ২৪৫টি, গত বছর ছিল ২৪২টি। বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসার পর প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে পূজার সংখ্যা বেড়েছে।
শান্তিপূর্ণ ও নির্বিঘ্ন করতে ঢাকার ২৪৬টি পূজামণ্ডপে সার্বিক নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি।
নির্দেশনাগুলোর মধ্যে আছে–প্রতিমা তৈরি থেকে পূজা শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মন্দির ও মণ্ডপে নিজ উদ্যোগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্দির ও মণ্ডপ কর্তৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মণ্ডপে নারী ও পুরুষের পৃথক যাতায়াত ব্যবস্থা রাখা এবং শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিজস্ব নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক রাখতে হবে। মণ্ডপে দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবকদের নামের তালিকা, মোবাইল ফোন নম্বরসহ জেলা ও কেন্দ্রে পাঠানো। সন্দেহভাজন দর্শনার্থীদের এবং নারী স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে নারী দর্শনার্থীদের দেহ তল্লাশির ব্যবস্থা রাখা। মাইক, পিএ-সেট, আতশবাজি ও পটকা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং ভক্তিমূলক ছাড়া অন্য কোনও গান না বাজানো। কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে–এমন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা। মন্দির ও মণ্ডপে আর্থিক সঙ্গতি সাপেক্ষে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা সংযোগের ব্যবস্থা করা। মণ্ডপ সংলগ্ন এলাকায় এবং বিসর্জনস্থলে পর্যাপ্ত আলো ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখা। অস্থায়ী মন্দিরগুলোর প্রতিমা বিজয়া দশমীর দিনেই বিসর্জন দেওয়া। দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পূজামণ্ডপ পরিদর্শনের সূচি থাকলে—অবশ্যই আগে থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানাকে জানানো। যৌন হয়রানি, ছিনতাই ইত্যাদিতে কেউ জড়িত হলে তাদের পুলিশে সোপর্দ করা। যানবাহন ও দর্শনার্থী চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে–এমন স্থানে পূজাকালীন কোনও দোকানপাট বরাদ্দ না দেওয়া। প্রতিমা নির্মাণ স্থান ও পূজামণ্ডপে স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
আজ ষষ্ঠী। শুক্রবার সকালে শুরু হবে দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতাআজ ষষ্ঠী। শুক্রবার সকালে শুরু হবে দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা
আগামী ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে বেলা তিনটার পর প্রতিটি মণ্ডপ থেকে সরাসরি প্রতিমা নিয়ে বিসর্জন ঘাটে যেতে হবে। মহানগর পূজা কমিটির নেতৃত্বে বেলা তিনটায় পলাশীর মোড় থেকে প্রতি বছরের মতো বিজয়া শোভাযাত্রা বিভিন্ন স্থান ঘুরে শেষ হবে বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজঘাটে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে। শোভাযাত্রা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে মহানগর পূজা কমিটির মনিটরিং সেল সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান জানান, মহালয়া থেকে আজকে পর্যন্ত এক ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। আগামীকাল থেকে পাঁচ দিনব্যাপী পূজার মূল কার্যক্রম শুরু হবে। মহাষষ্ঠী থেকে বিসর্জন পর্যন্ত পুরো সময়টাই পুলিশ, আনসারসহ যেসব স্বেচ্ছাসেবক দল রয়েছে, তাদের সহযোগিতায় নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে সিভিল পোশাকেও লোক রাখা হয়েছে। আয়োজকদের সঙ্গে আমাদের একাধিকবার বিভিন্ন সভা হয়েছে। আমরা আশা করি আগামী পাঁচ দিন অত্যন্ত সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে সক্ষম হবো।
তিনি বলেন, ‘২৪৮টি পূজামণ্ডপের মধ্যে সাতটি ছোট, বাকি সব মণ্ডপের নিরাপত্তায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং কম গুরুত্বপূর্ণ—এই দুই ভাগে ভাগ করে নিরাপত্তা প্রস্তুতি সাজানো হয়েছে। যেহেতু এটি (ঢাকেশ্বরী) প্রধান পূজামণ্ডপ, প্রধানমন্ত্রী এখানে এসে থাকেন এবং জাতীয় পূজামণ্ডপ এটি, এখানে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে প্রত্যেকটি জায়গায় আর্চওয়ে এবং বিশেষ টিম থাকবে। প্রত্যেকটি পূজামণ্ডপেই সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।