শিক্ষক নিয়োগে নতুন আদেশ নিয়ে তোলপাড়

শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে সারাদেশের মাদাসায় শিক্ষক নিয়োগে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের প্রতিনিধি করার এক আদেশ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে।

মাদরাসা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) পদে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারকে বাদ দেয়ায় সৃষ্ট অসন্তোষের মধ্যেই বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরের জারি করা আদেশ নিয়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষকদের মাঝে।

মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষায় সক্রিয় শিক্ষক সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে আদেশ প্রত্যাহার করে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের ক্ষমতা পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় লাগাতার কর্মসূচীর ডাক দেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা।

এদিকে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আদেশ নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে রাজি না হলেও কর্মকর্তাদের অনেকেই বলছেন, এ আদেশে তারা করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তবে সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনের নেতারাও শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার এমন আদেশ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এটা ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় এ ঘটনায় অসন্তোষ সৃষ্টি হলে তার সুযোগ নেবে অনেকেই। যা সঙ্কটের কারণ হতে পারে। তাই এমন কিছু করা যাবে না যা সরকারকে বিব্রত করবে।

অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজির পদে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের বাইরে গিয়ে নিয়োগ দেয়ার পর থেকেই অসন্তোষ বেড়েছে। অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার আগে মাদরাসা শিক্ষা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি শাখা। আর অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে সব সময় আছেন বিসিএস ক্যাডারের শিক্ষকরাই। ফলে নিয়োগে ডিজির প্রতিনিধিও রাখা হয় সরকারী কলেজর শিক্ষক কিংবা শিক্ষা প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। কিন্তু মাদরাসা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পরই এ পদে নিয়োগ পান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। গত ১ বছর আগে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর এক আত্মীয়র সঙ্গে গোপন বৈঠকের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টির মধ্যেই বিদায় নিতে হয় মহাপরিচালকদের। সেখানে আবার নিয়োগ পান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা। এখন ডিজি হিসেবে আছেন অতিরিক্ত সচিব সফিউদ্দিন আহমদ।
এসব ঘটনায় সৃষ্ট অসন্তোষের মধ্যেই মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রমে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসককে সরকারী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার আদেশ জারি করেছে অধিদপ্তর। মহাপরিচালক সফিউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে মহাপরিচালকের (ডিজি) প্রতিনিধি হিসেবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসককে মনোনয়ন দেয়া হবে বা তারা অন্য প্রতিনিধি দেবেন। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষক-কর্মচারীসহ সকল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা প্রযোজ্য বলে গণ্য হবে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করারও নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদরাসার শীর্ষ পদ দুটিতে নিয়োগ দিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ একটি গ্রম্নপ নানা ধরনের বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মাদরাসা অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেট। অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ পাইয়ে দিতে স্থানীয় ও অধিদপ্তরের একটি বলয় তৈরি করে। কখনো স্থানীয় বিষয়াদি না জেনেই হঠাৎ করে একজন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে দেন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি।

এছাড়া মাদরাসা অধিদপ্তরের শিক্ষা ক্যাডারের একজন উপ-পরিচালক এবং একজন সহকারী পরিচালক মিলে সব নিয়োগ কমিটি যান। সারাদেশ থেকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর উপ-পরিচালককে বদলি করলেও অদৃশ্য কারণে এখনও রয়েছেন অধিদপ্তরে। নানা চেষ্টায় এ বলয় ভাঙাতে না পেরে ডিসি-ইউএনওদের মাধ্যমে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগ।

কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মুনসী শাহাবুদ্দীন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মাদরাসা অধিপ্তরের কর্মকর্তা নাই বললেই চলে। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন দিয়ে মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও সুপার, ভাইস প্রিন্সিপাল নিয়োগ কমিটিতে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা থাকবে। জেলা পর্যায়ে ডিসির এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিনিধি থাকবে। এর ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা কমার পাশাপাশি আরও স্বচ্ছতা আসবে বলে আমরা মনে করেছি। তাই অধিদপ্তরকে এ নির্দেশনা দিয়েছি।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়োগ সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অধিদপ্তরের কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে বলেই আমরা স্বচ্ছতা চাচ্ছি।

এ বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেসীনের মহাসচিব সাব্বির আহমেদ মমতাজী আদেশের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, সারাদেশের শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনকে মর্যাদা ও কর্তৃত্ব শূন্য করার এটা একটা উদ্যোগ। আমরা এ সিদ্ধান্ত কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য মনে করি না। মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি শিক্ষক তাই সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনকে মর্যাদা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মাদরাসার জিডি শিক্ষা ক্যাডারের নয় বলেই তার কারণেই এ ধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত এসেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই এটা মানব না। আমরা বহুবার দেখা করে বলেছি শিক্ষা প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে নিয়োগ কমিটি করার জন্য। কিন্তু তা না করে এখন উল্টো যে কাজটা অধিদপ্তর করেছে তাতে সারাদেশে অসন্তোষ হবে। শিক্ষার ক্ষতি হবে। তাই এটা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত।

এদিকে স্বাধীনতা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সাজাহান আলম সাজু বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। অন্যথায় সমস্যা বাড়তে পারে। তাছাড়া এতে নিয়োগে যে অনিয়ম দুর্নীতি বাড়বে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে। তাই হুট করে এটা করা কোনভাবেই উচিত নয়।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।