বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা নিয়ে ব্যাপকহারে জাল-জালিয়াতি, দুর্নীতি হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাও মানা হয়নি। ২৬ হাজার ১শ’ ৯৩টি স্কুল জাতীয়করণের জন্য প্রধানমন্ত্রী যে তালিকা অনুমোদন করেছেন সেটি চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তালিকার বাইরের অনেক স্কুল জাতীয়করণ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে তালিকার মধ্যের অনেক স্কুলকে বাদ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার সঙ্গে প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এসব করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্কুল জাতীয়করণকে কেন্দ্র করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যাপকহারে ঘুষ লেনদেন হয়েছে। স্কুল জাতীয়করণ বাণিজ্যের সুবাদে একটি মহল হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। ঘুষের মাত্রা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপনের তালিকায় স্কুলের নাম ঢুকেছে অথবা বাদ পড়েছে। যেসব স্কুলের তদবিরকারকরা টাকা দিতে পেরেছেন তাদের স্কুলকে তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। অন্যদিকে যারা টাকা দেননি বা কম টাকা দিয়েছেন তাদের স্কুলকে বাদ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর দালালের মাধ্যমে এসব ঘুষ লেনদেন হয়েছে। এ বাণিজ্যের সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ পর্যন্ত কতটি স্কুল জাতীয়করণ হয়েছে প্রজ্ঞাপনভিত্তিক সুনির্দিষ্ট হিসাব মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। তবে মন্ত্রণালয়ের মৌখিক হিসাব অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত ২৬ হাজার ১শ’ ৯৩টি স্কুলের কোটা পূরণ হতে আর মাত্র ৩৪টি স্কুল বাকি আছে। অর্থাৎ (২৬,১৯৩-৩৪)=২৬,১৫৯টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ইতিমধ্যে জাতীয়করণ করা হয়েছে। কিন্তু, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর তালিকার ৭৩টি স্কুল আছে যেগুলো এখন পর্যন্ত জাতীয়করণ করা হয়নি। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর তালিকার (৭৩-৩৪)= ৩৯টি স্কুল কীভাবে বাদ পড়ছে? এসব স্কুলের স্থলে নিশ্চয়ই অন্য নতুন স্কুল ঢুকে পড়েছে?
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারছেন না। মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের সঙ্গে এ নিয়ে সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের পক্ষ থেকে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বরাবরই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একাধিকবার সময় দিয়েও তিনি তা রক্ষা করেননি।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানীর প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত শিক্ষক মহাসমাবেশে ২৬ হাজার ১শ’ ৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রস্তুতি হিসেবে সারাদেশ থেকে তথ্য নিয়ে আগেই এই ২৬ হাজার ১শ’ ৯৩ স্কুলের তালিকা তৈরি করা হয়েছিলো। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুশাসনও নেয়া হয়েছিলো।
জানা গেছে, স্কুলের ক্যাটাগরি অনুযায়ী শুরুতে সবগুলো স্কুলকে তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকটি ধাপের সব স্কুল এক প্রজ্ঞাপনে জাতীয়করণ করার কথা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি। বিশেষ করে তৃতীয় ধাপের স্কুল জাতীয়করণ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো প্রজ্ঞাপনে। দেখা যাচ্ছে, কখনো কখনো অল্প বা গুটিকয়েক স্কুলকে জাতীয়করণের জন্যও আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কিন্তু কেন এভাবে দফায় দফায় আলাদা প্রজ্ঞাপন করা হলো, এর কোনো জবাব নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত ২৬ হাজার ১শ’ ৯৩ স্কুলের তালিকা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোথাও প্রমাণসাপেক্ষভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। আর তাই সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষেরও চ্যালেঞ্জ করার কোন সুযোগ ছিলো না। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মর্জির উপর নির্ভর করতে হয়েছে মানুষকে। কর্মকর্তারা যখন যা বলেছেন সেটিই মানুষকে মেনে নিতে হয়েছে। কর্মকর্তারা কখনো বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় ‘ওমুক স্কুল’ আছে। আবার কখনো বলেছেন, ‘নেই’।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রীর তালিকার কথা বলে শুধুই সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। আদতে অনেক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর তালিকা অনুসরণই করা হয়নি। কর্মকর্তারা এ মুহূর্তে অফিসিয়ালি স্বীকার করছেন, প্রধানমন্ত্রীর তালিকার ৩৯টি স্কুল জাতীয়করণের বাইরে অতিরিক্ত রয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এগুলোর স্থলে অন্য স্কুল জাতীয়করণ হয়ে গেছে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বাস্তবে শুধু ৩৯টিই নয়, প্রধানমন্ত্রীর তালিকার এরকমের শত শত স্কুল রয়ে গেছে যেগুলো জাতীয়করণ করা হয়নি। এসব স্কুলের পরিবর্তে কারসাজির মাধ্যমে অন্য স্কুল ঢোকানো জাতীয়করণের প্রজ্ঞাপনে। এসব স্কুলের পরিচালনা কমিটির সদস্য অথবা শিক্ষকরা ঢাকায় এসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় ধর্ণা দিচ্ছেন। তাদেরকে আগে এক সময় বলা হয়েছে তালিকায় নাম আছে। এখন বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় নাম নেই। কিন্তু তাদের কাছে এমন কোন প্রমাণও নেই যে তারা চ্যালেঞ্জ করবেন- তালিকায় নাম আছে কি নেই। শুধুই আফসোস করছেন, তখন চাহিদামতো টাকা দিলে স্কুল জাতীয়করণ হয়ে যেতো। এ সংকটে আর পড়তে হতো না।
স্কুল জাতীয়করণের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত সার-সংক্ষেপ এবং প্রজ্ঞাপনের কপি নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় নিরাপদ স্থানে সংরক্ষিত থাকার কথা। অথচ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল জাতীয়করণের এই প্রজ্ঞাপনগুলো দেখাতে পারছে না। প্রজ্ঞাপন বিষয়ে এক ধরনের লুকোচুরি চলছে বলা যায়। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথ রায়ের মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই প্রজ্ঞাপনগুলোর তথ্য চাওয়া হয়েছিল শীর্ষ কাগজের পক্ষ থেকে। গত ৭ মে রবীন্দ্রনাথ রায় এ তথ্যগুলো সরবরাহের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন। কিন্তু, ১৬ মে পর্যন্ত তিনি এ তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। ১৬ মে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের সঙ্গে তার দফতরে সাক্ষাত করে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রী শুরুতে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেদিন তিনি ব্যস্ত আছেন এবং পরদিন সকাল ১১ টায় এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে জানান। শীর্ষকাগজের এ প্রতিবেদক পরদিন সকাল ১১টায় তার দফতরে গিয়ে জানতে পারেন, মন্ত্রী অফিসে আসেননি এবং এদিন আর আসবেনই না। এরপর ২৮ মে মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে কথা বলতে চাইলে সেদিনও তিনি এড়িয়ে যান। ৩০ মে কথা বলবেন বলে আবারো সময় দেন। কিন্তু, ৩০মে তিনি অফিসেই আসেননি।