সর্বদা বৈষম্যের শিকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:  ৩৪তম বিসিএস-এ উত্তীর্ণ নন-ক্যাডারদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে  ১০ম গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হলেও দুই গ্রেড কমে ১২তম গ্রেডে নিয়োগ পাচ্ছেন সরকারি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা। একই মেধা ও যোগ্যতা থাকার পরও শুধু শিক্ষক হওয়ার কারণে এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি বলছে, দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই বৈষম্যের শিকার। নতুন করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণরা এ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। দ্রুত এই বৈষম্য দূর করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ৮৯৮ জনকে নন-ক্যাডার হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। একই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও প্রায় সমান মেধার অধিকারী অন্য প্রার্থীদেরও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন নন-ক্যাডার পদে দশম গ্রেডে নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের দুই ধাপ নিচে ১২তম গ্রেডে (১১ হাজার ৩০০ টাকা, প্রশিক্ষণবিহীন হওয়ায়) নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়াও শেষ পর্যায়ে। এটি কার্যকর হলে নবনিযুক্ত  প্রধান শিক্ষকরা অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পাওয়া তাদের সমান মেধার অধিকারী প্রার্থীদের চেয়ে মূল বেতন কম পাবেন ৪ হাজার ৭০০ টাকা। সে হিসেবে প্রতি মাসে কম পাবেন ৬ হাজার ৭৮৫ টাকা।

৩৪তম বিসিএসে নন-ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মুখ্য পরিদর্শক, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঞ্চয় অফিসার, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে শ্রম পরিদর্শক, সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমাজসেবা অফিসার ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সহকারী প্রটোকল অফিসারসহ পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্তদের দশম গ্রেডে নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। ব্যতিক্রম শুধু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে। তারা সুপারিশ প্রাপ্তদের ১২তম গ্রেডে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্তরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে এই বৈষম্য নিরসনের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ ইতিমধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। পিএসসি থেকেও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। পিএসসি কখনও ১০ম গ্রেডের নিচে নিয়োগ দেয় না। তারা বলছেন, জটিলতায় ফেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা অবনমন করে রাখার চেষ্টা চলছে। এর জন্য সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একে অপরকে দায়ী করছেন।
এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামান বলেন, বিদ্যমান আইনে প্রধান শিক্ষকরা যে গ্রেডে নিয়োগ পান, নন-ক্যাডার সেভাবেই নিয়োগ পেয়েছেন। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ আগেও তারা ১২তম গ্রেডে নিয়োগ পাচ্ছে এবং সেই গ্রেডে বেতন পাবে। আর পিএসসি চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পদের নাম উল্লেখ করেছে। কোন গ্রেড হবে তা তারা বলেনি। এখন এই পদ কোন গ্রেডের সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সিদ্ধান্ত নেবে। তবে পিএসসি কখনও তৃতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের সুপারিশ করে না।

সরকারি প্রাথমিক  প্রধান শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক খাইরুল ইসলাম বলেন আমাদের নায্য দাবী ১০ম গ্রেড এবং নিয়োগ বিধি সংশোধন। এদাবীর জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি।

এ ব্যাপারে  সরকারি প্রাথমিক  প্রধান শিক্ষক সমিতির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র এসএম ছায়িদ উল্লা বলেন, আগের প্রধান শিক্ষকরা পিএসসির পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নিয়োগ পাননি। তা ছাড়া পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির হওয়ার কারণেই পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ হচ্ছে। তাহলে কেন আগের মতো তৃতীয় শ্রেণির গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হবে। ওই গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হলে মন্ত্রণালয় নিজেরাই আগের মতো পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দিতে পারত। তিনি বলেন, আমরা দ্রুত এই সমস্যা সমাধান চাই।

সরকারি প্রাথমিক  প্রধান শিক্ষক সমিতির  সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বরুপ দাস  বলেন বলেন, অন্য কোনো সমস্যা নেই। শুধু শিক্ষক এজন্য তাদের যত ধরনের হেয় করা যায় তার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, এক শ্রেণির আমলা  শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে রাজি নয়। এরই ধারাবাহিকতা আমরা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যে শিকার। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে আগে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। না হয় মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসবে না।

সরকারি প্রাথমিক  প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি রিয়াজ পারবেজ বলেন ,দীর্ঘদিন ধরে আমরা মন্ত্রনালয়ে ঘুরেও কোন সমাধান পায়নি। তাই আমরা এখন হাই কোর্ট এর দারস্থ হচ্ছি।

সূত্র জানায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদটি ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু তখন মন্ত্রণালয় কৌশলে প্রধান শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করে ১১তম (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) ও ১২তম গ্রেডে (প্রশিক্ষণবিহীন)। ওই সময় যুক্তি দেখানো হয়- সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার পদটি বর্তমানে দশম গ্রেডের। তারা মূলত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে থাকেন। প্রধান শিক্ষকদের পদ সম গ্রেডের হলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে এখন বিসিএসে উত্তীর্ণদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম বাস্তবায়ন করতে চাইছে মন্ত্রণালয়। এখন বিসিএসে উত্তীর্ণদের প্রশ্ন, যদি অন্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থদের দশম গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে তাদের কেন এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে। একই মেধায় উত্তীর্ণ হলেও কেন তাদের দুই গ্রেড নিচের চাকরিতে যোগদান করতে হবে। এতে অন্যদের চেয়ে তাদের বেতন স্কেল কম হবে ৪ হাজার ৭০০ টাকা। ১২তম গ্রেডে মূল বেতন ১১ হাজার ৩০০ টাকার ৫৫ ভাগ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা ও টিফিন ভাতা ৫০০ টাকা। এ হিসেবে মোট বেতন হয় ১৯ হাজার ৫১৫ টাকা। অন্যদিকে দশম গ্রেডে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকার ৫৫ ভাগ বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা হিসেবে মোট পাবেন ২৬ হাজার ৩০০ টাকা। ফলে প্রতিমাসে তারা ৬ হাজার ৭৮৫ টাকা কম পাবে। এতে তাদের সামাজিক অবস্থান দশম গ্রেডধারীদের তুলনায় নিচে হবে। এ রকম করলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতায় আসতে চাইবেন না।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।