শিক্ষাক্ষেত্রে অবকাঠামো ও অন্যান্য বিষয়ে উন্নয়ন হলেও মানসম্পন্ন শিক্ষায় দেশ অনেক পিছিয়ে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সময় এসেছে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার দিকে মনোযোগ দেয়ার। আর এ জন্য তারা শিক্ষায় বিশেষায়ণ পদ্ধতি, মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনা, মানসম্পন্ন বিদ্যালয় গড়ে তোলার মতো পরামর্শ তুলে ধরেছেন।
বুধবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘এজেন্ডা ২০৩০: শিক্ষার নতুন দিগন্ত, ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও আগামীর ভাবনা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এ পরামর্শ দেয়া হয়।
সেমিনারের আয়োজন করে ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’ ও ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ’।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগে আমরা পরিমাণের দিকে লক্ষ রেখেছি, এখন আমাদের গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার দিকে নজর দিতে হবে।’ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ৪০ শতাংশ যুবক শিক্ষিত হয়েও চাকরি পাচ্ছে না। তাহলে তারা কী শিক্ষা নিয়েছে।
টেকসই মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা করার তাগিদ দিয়ে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের ভাইস চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আলম বলেন, ‘কীভাবে আমরা সেখানে যেতে পারি তার কাঠামো তৈরি করতে হবে। শিক্ষকতায় আনতে হবে মেধাবীদের।’ স্কুল পর্যায়ে পরীক্ষা কম নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এত পরীক্ষা নিয়ে কী লাভ হচ্ছে আমাদের।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী এডুকেশন ওয়াচের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, প্রাইমারি পাস করছে কিন্তু ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো সাক্ষরতা অর্জন করতে পারেনি। তাই শিক্ষার মান উন্নয়নে শুধু সরকারের দিকে না তাকিয়ে থেকে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য বিশেষায়ণ একটি ভালো পদ্ধতি হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘কোয়ালিটি শিক্ষা বাড়াতে হলে সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বিশেষায়ণ বাড়াতে হবে। বিজ্ঞানের ছেলেকে বিজ্ঞানের জায়গায় বসাতে হবে। যিনি অঙ্কে বিশেষজ্ঞ তাকে অঙ্ক দিতে হবে। যার যার বিশেষত্বের জায়গায় দায়িত্ব দিলে শিক্ষার মান বাড়বে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে বৈপ্লবিক চিন্তার সময় এসেছে। দেখা যাচ্ছে অনেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেও বেকার। আমাদের আবকাঠামোর জন্য বৃহৎ চিন্তা আছে কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সেটা নেই। আর মানসম্পন্ন শিক্ষা এখন শুধু অভিজাত শ্রেণীর জন্য হয়ে গেছে।
মাধ্যমিক শিক্ষায় বিপ্লব ঘটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে হোসেন জিল্লুরের পরামর্শ, ‘এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান না বাড়িয়ে আগামী ১৫ বছরে এক হাজার কোয়ালিটি মাধ্যমিক স্কুল গঠন করুন।’ এর পেছনে তার পর্যবেক্ষণ হলো, জেলা স্কুলের সফলতার হার এখনো অনেক ভালো, কারণ সেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া হয়।
মানসম্পন্ন শিক্ষা না পাওয়ার ক্ষেত্রেপর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবও একটা কারণ বলছেন নটরডেম কলেজের সাবেক অধ্যাপক রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, শিক্ষকের আভাব রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা হবে না। পত্রিকার প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, দেশে ১৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক নেই। তাহলে কীভাবে সেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা হবে!
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের সফলতা ও কার্যক্রম তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার বরাদ্দ কোথায় যাচ্ছে সেটি সুশীল সমাজকে খোঁজার তাগিদ দেন। তিনি সুশীল সমাজের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের অনেক চাপ থাকে, তাই আপনাদের এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হলেও গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা শিগগির কারিকুলাম রিভিউ করছি। আমাদের শিক্ষকদের উন্নয়নে কাজ করছি। ছোট থেকেই শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষক হিসেবে তৈরি হয় সে ব্যাপারে কাজ করছি।’ শিক্ষার আরো উন্নয়নে তারা আশাবাদী বলে জানান তিনি।
রাতারাতি শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয় জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা তিন কোটি ৩২ লাখ অশিক্ষিতে জন্য ডাটা তৈরি করছি। জানুয়ারিতে শুরু হবে এর কাজ।’
রাশেদা কে চৌধূরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল আলম।