প্রতিবেদক যে সব প্রশ্ন করেছেন, তবে বেশিরভাগই সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন। কোন দেশের রাজধানী কোথায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস কত তারিখ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কত তারিখ। শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধ কোথায় ইত্যাদি।
নৈতিকতার দিক থেকে দেখলে কোনো মতেই এই প্রতিবেদনটিকে মেনে নেয়া যায় না। যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে, সেগুলো দিয়ে কী সত্যিই কারও ‘জ্ঞান-মান’ মাপা যায়? আর এসব প্রশ্নের জবাব দেশের কয়জন ‘শিক্ষিত’ মানুষ জানে? শিক্ষকরা জানে তো? কয়জন পারবে ওই প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর দিতে? সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা ভুলভাল উত্তর দেওয়ায় অনেকের মধ্যেই ‘মজা লওয়া’র বিকার লক্ষ করা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনের আনন্দে অনেকে লাখ লাখ কমেন্ট আর শেয়ার দিয়েছেন, কিন্তু কেউ তলিয়ে দেখেননি, এমন উত্তর তারা কেন দিয়েছে? তাদের কারা শেখায়? কী শেখায়?
উল্লিখিত প্রতিবেদনটিতে শিক্ষার্থীদের অজ্ঞতার একটা খন্ড চিত্র হয়তো পাওয়া গেছে। কিন্তু সামাজিক মানুষ হিসেবে আমরা কতটা মূর্খ ও বিকারগ্রস্ত-তার একটা অখন্ড চিত্রও বের হয়ে এসেছে! প্রতিবেদককে হয়তো এ ব্যাপারে ততটা দায়ী করা চলে না, একজন প্রতিবেদকের বুদ্ধি-বিচারের ঘাটতি থাকতেই পারে। কিন্তু টিভি চ্যানেলের যারা কর্তাব্যক্তি ছিলেন, তারা এমন একটা প্রতিবেদন কোন বিবেচনায় প্রচার করলেন? আর ফেসবুকেই বা তা হাজার হাজার মানুষ শেয়ার দিলেন কেন? শিক্ষার ‘নিম্নমান’ দেখাতে কিছু নিষ্পাপ কিশোরকিশোরীকে ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়ে জাতির সামনে উপস্থাপন করাটা কতটা নৈতিক? তবে কী সামিষ্টিকভাবেই আমাদের বুদ্ধি-বিবেচনা লোপ পেয়েছে?
বিশেষ করে যে দুটি মেয়েকে কিছু আলটপকা প্রশ্ন করে বোকা বানানো হলো, গোটা দেশের মানুষের কাছে তাদের মানমর্যাদা বিনষ্ট করা হলো, তা কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করা যায় না। এটা শুধু নৈতিকতা বিরুদ্ধ নয়, অপরাধও বটে। কাউকে জনসমক্ষে হেয় করার অধিকার কোনো মিডিয়ার থাকতে পারে না।
এমনিতেই আমাদের সমাজে নারীকে অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। আমাদের পুরো সমাজেই নারীবিরোধী উপাদানে ভরপুর। সবাই তক্কে-তক্কে থাকে নারীর খুঁত ধরার জন্য, সেখানে দুটি মেয়েকে এভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তাদের পরবর্তী জীবনকে বিষিয়ে তোলার দায় কে নেবে? তাদের মধ্যে এরপর স্টিগমা তৈরি হতে পারে। আত্মবিশ্বাসহীনতা ও দ্বিধাও তৈরি হতে পারে। তাদের মধ্যে একটা ভয় ও হীনমন্যতা গ্রাস করতে পারে। এমনকি মেয়ে দুটির নিজেদের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নেতিবাচক দিকে ঝুঁকে পড়ারও আশঙ্কা আছে। এটা কোনো মিডিয়াই করতে পারে না।
মেয়েদের বেলায় যে কোনো ঘটনা আলাদাভাবে এবং বিশেষভাবে ভাবতে হয় এ কারণে যে, আমাদের সমাজের প্রচলিত নিয়মে ছেলেদের কোনো ‘কলঙ্ক’ বা ‘অপমান’ হয় না। পুরুষশাসিত সমাজে তাদের ত্রুটি দুর্বলতাগুলো লঘু করে দেখা হয়। পুরুষবাদী ও পুরুষবান্ধব সমাজে ছেলেরা সহজেই যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি এমনকি অপমান পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারে, কাটিয়ে উঠার সুযোগ পায়। কিন্তু মেয়েরা তা পারে না। তাদের সেই সুযোগ দেয়াও হয় না। কোনো ঘটনা ঘটলে সবাই মিলে মেয়েটিকেই কোনঠাসা করে ফেলা হয়। কাজেই মেয়েদের ব্যাপারে অধিক সংবেদনশীলতা সব সময় কাম্য। যা সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটিতে নেই।
আমাদের শিক্ষার মান খারাপ এটা সবাই জানে। তারপরও কেউ যদি এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো প্রতিবেদন তৈরি করতে বা সমীক্ষা চালাতে চায়, এ জন্য বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়। যার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, তাকে আগেই প্রশ্ন দেখাতে হয়, সেটা যে মিডিয়ায় প্রচার করা হবে, এটাও আগেই জানাতে হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট এই প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানা হয়েছে বলে মনে হয় না। আর নিয়ম মানা হলে কেউই সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হতো না। প্রতিবেদনে যা দেখানো হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব দিতে পারেননি। জবাব না দিতে পারায় তাদের লজ্জা এবং আড়ষ্ট ভাব প্রকাশ পেয়েছে।
তাহলে এমন একটা কাণ্ড কেন করা হলো? যারা হুজুগে ‘খারাপ মানের’ জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা প্রতিবেদনটি ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছেন তারা কী খুব উচ্চ মানের কাজ করেছেন? ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান থাকলে কেউ এটা করতে পারেন না। একটি সভ্য-শিক্ষিত সমাজে সবারই দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত।
ওই টিভি চ্যানেলটি কয়েকটি শিশুকে ‘আহাম্মক’ হিসেবে দেখিয়ে নিঃসন্দেহে একটা গর্হিত কাজ করেছে। তাদের উচিত ছিল সাক্ষাৎকারদাতা শিশুদের মুখগুলো আবছা করে দেওয়া। সংবেদনশীল প্রতিবেদনে শুধু ভিকটিমদের নয়, দাগী অপরাধীদেরও চেহারা আবছা করে দেওয়াই নিয়ম। এখানে এই শিশুরা ‘ভিকটিম’ মাত্র। তাদের চেহারা স্পষ্ট করে দিয়ে কয়েকটি শিশুর সঙ্গে চরম অসংবেদনশীল আচরণ করা হয়েছে।
আমাদের শিক্ষার সামগ্রিক মানের যে অধঃপতন-তা নিয়ে আলাপআলোচনা কিছু কম হচ্ছে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপ প্রতিবেদনেও তা উঠে আসছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘র্যাং কিং ওয়েব অফ ইউনিভার্সিটি’ এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিক্ষার গুণগত মান বিচারে বাংলাদেশের কোন বিশ্ব বিদ্যালয়ই সেরা ২১০০ এর মধ্যে স্থান পায় নাই। এমনকি এশিয়ার সেরা ৭০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ও আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নাই। এর থেকেই বোঝা যায় যে, আমাদের শিক্ষার মান কত নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে।
গত তিন বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কথিত ‘মেধাবী’দের ৮০ ভাগই পাস নম্বর পাননি! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজিতে ৩০ নম্বরের মধ্যে ন্যূনতম ৮ নম্বর পাননি এমন পরীক্ষার্থীর হার যথাক্রমে ৫৫% ও ৫৬%!
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা- এই চার স্তরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে মাধ্যমিক স্তর। কারণ এই স্তরেই শিক্ষার্থীদের গড়ে ওঠার সময়। অথচ এ পর্বের শিক্ষকরাই বেশি অদক্ষ। এই স্তরের বেশির ভাগ স্কুলই এমপিওভুক্ত। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষক হতে গেলে দক্ষতা নয়, প্রয়োজন হয় টাকার। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণব্যবস্থাও তেমন জোরালো নয়। সরকার এই স্তরকে ঢেলে সাজাতে ২০০৮ সাল থেকে চালু করে সৃজনশীল পদ্ধতি। কিন্তু সেই সৃজনশীল এখন হয়ে গেছে নোট-গাইডনির্ভর।
শিক্ষকরা এখনো পারেন না সৃজনশীল প্রশ্ন করতে। তারা ক্লাসের চেয়ে কোচিংয়ে পড়াতেই বেশি পছন্দ করছেন। তাই পড়ালেখায় মন না দিয়ে শিক্ষার্থীদের ছুটতে হচ্ছে এক শিক্ষক থেকে থেকে আরেক শিক্ষকের কাছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা ছাড়া কোনো শিক্ষকই নিয়োগ পান না। কত টাকা দিতে হবে, তাও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি নির্ধারণ করে দেয়। যোগ্য প্রার্থীরা টাকা না দিতে পারলে নানা কৌশলে নিয়োগ স্থগিত রাখা হয়। পরিচালনা কমিটির ওপর শিক্ষা প্রশাসনের তদারকি না থাকায় তারা ইচ্ছামতো চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠান। মানের দিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই।
মূলতঃ শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে যে আশঙ্কাজনক অধঃপতন হয়েছে, তার জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থাটাই দায়ী। স্কুল-কলেজে ভাষা বিষয়ে যথাযথ শিক্ষা না দেওয়া, বিষয়ভিত্তিক যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারা, গভীর পাঠদান ও পাঠাভ্যাসের অনুপস্থিতি, পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিষয়ে পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া, ‘শর্টকাট’ উপায়ে সফল হওয়ার প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীলতা, বাড়িয়ে বাড়িয়ে নম্বর দিয়ে কৃত্রিমভাবে মেধার বিস্ফোরণ ঘটানোর নীতি-এসব
কিছুর সম্মিলিত ফলাফল হচ্ছে শিক্ষার মানে ধস। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই সতর্ক না হলে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক ফল গ্রাস করবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে। সকলের টনক কবে নড়বে সেটাই দেখার বিষয়।
চিররঞ্জন সরকার : লেখক, কলামিস্ট।
[email protected]