প্রাথমিক শিক্ষকদের করুন কাহিনী

তৌহিদুজ্জামান সোহেল

আমি ৩৬ তম বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে সুপারিশ একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আমিও মানুষ তাই আমিও ভুল করতে পারি। আজ আমার লেখার বিষয়বস্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবন ও বাস্তবতা। লেখার শুরুতে বলে রাখি আমার কথাতে কেউ কষ্ট পেলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।



প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক হচ্ছেন প্রধান শিক্ষক। একটি সংসার চালানো যে কী কঠিন তা যে চালায় সেই বোঝে। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫-৬ জন শিক্ষক কোন কোন বিদ্যালয়ের ৭-৮ জনও থাকে, যারা ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে আসেন। এদের মন মানসিকতাও ভিন্ন। সবাইকে সামাল দিতে প্রধান শিক্ষক কম কষ্ট করেন না। অথচ সেই প্রধান শিক্ষক এখনো দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পাননি।

জানামতে, প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেড দ্বিতীয় শ্রেণীর হওয়ার ঘোষণা প্রদান করে কিন্তু এখনও তা বাস্তবে প্রমাণিত হয় নি। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। কিন্তু বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগ দিয়েও তাদেরকে ১২ তম গ্রেড এ রাখা হয়েছে কিন্তু একই সাথে একই পরীক্ষা দিয়ে কেউ ৯ম কিংবা ১০ম গ্রেডে সেখানে শিক্ষার মূল ভিত্তিতে ১২ তম গ্রেডে সুপারিশ করা হয়েছে । যতদিন না বেতন বৈষম্য ঠিক হবে এবং মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতি কার্যকর হবে ততদিন প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই সমস্যা দূর না করলে প্রাথমিক এর মান বাড়ানো যাবে না।

কর্তাব্যক্তিরা নিয়মিত আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের সে আশা এখনও আশার আলো দেখেনি আর কবে আশা পূরণ হবে তাও কেউ জানে না। সহকারী শিক্ষকরা তো সবচেয়ে বড় বলির পাঁঠা। সকাল নয়টায় বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া, বিদ্যালয় পরিষ্কার করা, ঘণ্টা বাজানো থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ তাদের করতে হয়। আর যে স্কুলে শিক্ষক কম তাদেরতো আরো কষ্ট যা বলে শেষ করা যাবে না। সাথে আরো নতুন নতুন নিয়মের পরিপত্র তো আছেই।

নয়টা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত মাঝখানে বিরতি মাত্র ত্রিশ মিনিট এমন রুটিন দেখে মনে হয় প্রাথমিকের শিক্ষকেরা রোবট। দুপুরের খাবার খেলে নামাজ পড়া হয় না, নামাজ পড়তে গেলে খাবারের সময় নেই। অথচ সেই সহকারী শিক্ষক হচ্ছেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী যা সকল শিক্ষক সমাজের জন্য অপমানজনক বলে আমার মনে হয়। কী লজ্জা! ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষকরা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন কিন্তু তাদেরকে শুধুই আশার বাণী শোনানো হচ্ছে। আদৌ কি তাদের আশা পূরণ হবে? নাকি শুভঙ্করের ফাঁকি?

প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণকৃত, অথচ দপ্তরিদের চাকরি জাতীয়করণ হয় না। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আগে শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে সাথে সাথে তাদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো শিক্ষা বান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত হয়ে গড়ে উঠে। তাই সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ এই যে, প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড অবিলম্বে কার্যকর করা হউক যাতে প্রাথমিকের শিক্ষকেরা সমাজে গর্ব করে বলতে পারুক যে আমি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। যেদিন শিক্ষকেরা মাথা উচু করে তারা তাদের পরিচয় দিতে কুন্ঠাবোধ করবে না সেদিন থেকে প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়বে।

লেখক: প্রধান শিক্ষক (৩৬ তম বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে সুপারিশ প্রাপ্ত)

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।