খুলনা প্রতিনিধি,৭ জুলাই:
খুলনার ১৩০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ায় একটি অ্যাম্বুলেন্স। সেখান থেকে তড়িঘড়ি নেমে এক তরুণ দৌড়ে ঢোকেন হাসপাতালের ভেতরে। আর অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে শুয়ে থাকা রোগীকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকেন এক বয়স্ক নারী। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে তখনো ওই রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া চলছে। হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে রোগীর।
পাশে থাকা নারী পানির বোতল থেকে রোগীর মুখে বারবার পানি ঢালছিলেন আর কানের কাছে গিয়ে জোরে জোরে সৃষ্টিকর্তার নাম জপ করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই তরুণের সঙ্গে কর্তব্যরত এক চিকিৎসক এসে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই হাতে পালস অক্সিমিটার দিয়ে পরীক্ষা করে বলেন, রোগী আর নেই। এরপর শুরু হয় ওই নারী ও ওই তরুণের আর্তনাদ।
আজ বুধবার বেলা পৌনে ১টার দিকের ঘটনা এটি। হঠাৎ করেই অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে থেকে ভেসে আসা আর্তনাদে পাল্টে যায় হাসপাতাল এলাকার চিত্র। মারা যাওয়া ওই ব্যক্তির নাম স্বপন হালদার (৬০)। বাড়ি খুলনা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়নে। আর ওই নারী হলেন তাঁর স্ত্রী। ওই তরুণ তাঁদের ছেলে।
ষাটোর্ধ্ব স্বপন হালদারকে খুলনা করোনা হাসপাতালে আনা হয়েছিল খুলনা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়ন থেকে।
হাসপাতালে আগেই পৌঁছানো স্বপন হালদারের ভাইপো পল্টন হালদার বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে জ্বরে ভুগছিলেন স্বপন হালদার। গ্রামের চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে খাচ্ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ শরীর খারাপ হতে শুরু করে, বাড়তে থাকে শ্বাসকষ্ট। আজ সকালে তাঁকে প্রথমে পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। তাঁর করোনা উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষা করানো হয়নি।
বিজ্ঞাপন
খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো অ্যাম্বুলেন্স থেকে আর নামানো হয়নি স্বপন হালদারকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ওই অ্যাম্বুলেন্সে করেই বাড়ি দিয়ে যাওয়া হয় তাঁর লাশ। পুরো ঘটনা ঘটে যায় ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে।
স্বপন হালদারের মৃত্যুতে তাঁর ছেলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। খুলনা ১৩০ শয্যাবিশিষ্ট ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে, ৭ জুলাই
স্বপন হালদারের মৃত্যুতে তাঁর ছেলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। খুলনা ১৩০ শয্যাবিশিষ্ট ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে, ৭ জুলাইছবি: সাদ্দাম হোসেন
এ ঘটনার রেশ না কাটতেই বেলা ১টা ২৫ মিনিটের দিকে ওই হাসপাতালেই একটি প্রাইভেট কারে করে নিয়ে আসা হয় গীতা রানী বিশ্বাসকে (৫৫)। তড়িঘড়ি ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তুলে হাসপাতালের মধ্যে নিয়ে যান স্বজনেরা। ১০ মিনিটের মধ্যেই আবার স্ট্রেচারেই ফেরত নিয়ে আসা হয় তাঁকে। তবে তখন আর জীবিত নেই গীতা রানী। তাঁদের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে। তাঁর ছেলে মদন বিশ্বাস আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘সকাল থেকে মায়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায় প্রাইভেট কার ভাড়া করে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি। কিন্তু কেউই চিকিৎসা দেয়নি। সবাই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছে। সেখানে নিয়ে এসেও মাকে বাঁচাতে পারলাম না।’
হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বলেন, এমন ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় রোগীদের নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিয়ে আসায় তাঁদের বাঁচানো যাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে কারও করোনার উপসর্গ থাকলেও প্রথম দিকে সেটিকে স্বজনেরা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। পরে অবস্থা খারাপ হলে তখন হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। এ ধরনের রোগী হাসপাতালে ভর্তির আগেই মারা যান বলে এ ধরনের মৃত্যুর কোনো হিসাবও রাখা হয় না হাসপাতালে।