সাময়িক পরীক্ষা বাদ, আসছে সামষ্টিক মূল্যায়ন

Image

নিজস্ব প্রতিবেদক,২৯ অক্টোবর ২০২২: পর্যাপ্ত প্রস্তুতি (পাইলটিং) ছাড়াই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন শিখন পদ্ধতিতে পড়াশোনা শুরু হচ্ছে। এর আগে চলতি শিক্ষাবর্ষে বছরজুড়ে নতুন পদ্ধতিতে পড়াশোনার জন্য দেশের ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং (পরীক্ষামূলক পাঠদান) হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বছরের অর্ধেক সময়জুড়ে মাত্র ৫১টি মাধ্যমিক স্কুল, ৯টি মাদ্রাসা ও ২টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং হয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষকরা নেতিবাচক রিপোর্ট পাঠালেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) তা আমলে নিচ্ছে না।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ছাড়াই সংস্থাটি অনেকটা গায়ের জোরে আগামী জানুয়ারি থেকে নতুন শিখন পদ্ধতিতে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পড়াশোনা শুরু করতে যাচ্ছে। অথচ নির্ধারিত সময়ে পাইলটিং না করতে পারায় দ্বিতীয় শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা একবছর পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

আরো পড়ুনঃ চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি : সুখবর পাচ্ছেন চাকরি প্রত্যাশীরা

আগামী জানুযারি থেকে দেশজুড়ে নতুনধারার এই পড়াশোনার কথা বললেও এখনো সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান ও ইতিহাস এবং ধর্ম বিষয়ের পাঠ্যবই-ই চূড়ান্ত করতে পারেনি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এর ফলে বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে সব বই হাতে পাচ্ছে না।
আগামী বছর থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে সাময়িক পরীক্ষা থাকছে না। ষান্মাসিক ও বার্ষিক নামে দুবার সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। তবে এর রূপরেখা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। সব মিলিয়ে আগামী জানুয়ারি থেকে দেশের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পড়াশোনায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

আরো পড়ুনঃ এমপিও আপিল কমিটির সভার তারিখ পরিবর্তন

এনসিটিবি সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা শুরু করতে চাইলে অন্তত একবছর আগে থেকে পুরোদমে প্রস্তুতিমূলক পাঠদান ভীষণ জরুরি। তবে ২০২৩ সাল থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের জন্য ২০২২ সালে পুরোদমে পাইলটিং হয়নি। প্রথমে দেশজুড়ে ১০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিংয়ের কথা বলা হলেও তা হচ্ছে মাত্র ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, তা-ও পুরোদমে এই ৬২টি প্রতিষ্ঠানে পাইলটিং হয়নি। গ্যাপ দিয়ে এসব স্কুলে নামকাওয়াস্তে পাইলটিং হয়েছে। কেন পাইলটিং থেকে ৩৮টি প্রতিষ্ঠান বাদ গেল এর কারণ জানানো হয়নি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে পাইলটিং শুরু হয়ে জুন মাসে গিয়ে থেমে যায়। পরে আগস্টের শেষ থেকে আবার শুরু হয়। পাইলটিংয়ের পুরো ফলাফল পেতে আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এর আগেই সারাদেশের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পড়াশোনা চালু হয়ে যাবে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি ছাড়া এই শিক্ষাক্রমে পাঠদান কে করাবেন? বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকদের অধিকাংশই এই পদ্ধতি সম্পর্কে অন্ধকারে রয়েছেন। যদিও শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনরা বলেছেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ২০২৩ সালজুড়ে পাইলটিং করে এর ফলাফল কেমন হয় তা জেনে ২০২৪ কিংবা ২০২৫ থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের পড়াশোনা শুরু করা উচিত ছিল। কিন্তু চাইলেও আমাদের সেই সুযোগ নেই। ফলে ২০২৩ সাল থেকেই নতুন পদ্ধতিতে পড়াশোনা শুরু করতে হচ্ছে।
২০২২ সালে যে পাইলটিং হয়েছে সেটি নিয়ে শিক্ষকরা নেতিবাচক মতামত পাঠিয়েছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত জুনে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে শিক্ষকদের সেসব প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শিক্ষকরা বলছিলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ইংরেজি বিষয় নিয়ে তাদের আপত্তি। এতে অনেক কঠিন শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি আরো কয়েকটি পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে তারা বলেছেন, আমাদের দেশের সঙ্গে এগুলো সম্পর্কিত নয়। মাদ্রাসা শিক্ষকরা নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। শিক্ষকদের সেসব আপত্তি সংশোধন করে আগস্ট থেকে সংশোধিত শিক্ষাক্রমে পাইলটিং শুরু হয়েছে, যা এখনো চলছে। আগামী জানুয়ারির আগে পাইলটিংয়ের পুরো রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। তার মতে, পরিস্থিতি যখন যেভাবে সামনে নিয়ে আসবে ঠিক সেভাবেই সমাধান দিতে হবে।

এনসিটিবির গবেষণা কর্মকর্তা মোর্শিদ আক্তার ভোরের কাগজের কাছে স্বীকার করে বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম শুরু করার আগে যে ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার সেটিতে আমরা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছি। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, সাধারণত জানুয়ারি থেকে পাইলটিং শুরু হয়। সেখানে গত মার্চে থেকে আমরা পাইলটিং শুরু করেছি। তারপরে জুনে গিয়ে বই না ছাপানোর কারণে দুই মাস পাইলটিং বন্ধ থাকে। তারপরেও আমরা যে প্রস্তুতি নিয়েছি তাতে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে অনায়াসে নতুন শিখন পদ্ধতিতে পড়াশোনা শুরু করা যাবে।
এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমে সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান ও ইতিহাস এবং ধর্ম বিষয়ের পাঠ্যবই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এনসিটিবি তাদের নিজেদের মতো করে বই দুটি চূড়ান্ত করলেও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নির্দেশে শেষ সময়ে এসে পর্যালোচনা শুরু হয়। এতে বই দুটি থেকে বেশ কয়েকটি অধ্যায় ও ছবি বাদ দিয়ে নতুন অধ্যায় ও ছবি সংযোজনের নির্দেশ দেয়া হয়। এনসিটিবির কর্মকর্তারা এখন সেই কাজই করছেন। এর ফলে আগামী ১ জানুয়ারি এই দুটি বই শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে না। ফেব্রুয়ারির শুরুতে গিয়ে পেতে পারে।
জানতে চাইলে গবেষণা কর্মকর্তা মোর্শিদ আক্তার বলেন, সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান ও ইতিহাস এবং ধর্ম বিষয়ের পাঠ্যবই চূড়ান্তকরণের কাজ এখনো চলছে। তবে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান ধর্ম বিষয়ের পাঠ্যবই চূড়ান্ত হয়েছে জানিয়ে বলেন, সামাজিক বিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ্যবই চূড়ান্ত হতে আরো কয়েকদিন লাগবে। এই বই দুটি ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে না- এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, বছরের প্রথমদিনই সব পাঠ্যবই না পেলেও চলে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই ৪ মাস পুরোদমে চলে বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণ। অক্টোবরের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ বছর দরপত্র জটিলতায় সবেমাত্র শুরু হয়েছে মুদ্রণ। আবার কাজ শুরু হতে না হতেই লোডশেডিংয়ের বড় জটিলতায় পড়েছেন মুদ্রণকারীরা। কাগজের মিলগুলো যথাসময়ে পর্যাপ্ত কাগজ সরবরাহ করতে পারছে না। আর মুদ্রণকারীরা লোডশেডিংয়ে টার্গেট অনুয়ায়ী ছাপার কাজ শেষ করতে পারছেন না। সব বাধা কাটিয়ে দ্রুত বই ছাপিয়ে শেষ করার জন্য যেন-তেন কাগজেই বই ছাপাচ্ছেন।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইয়ের কাজ পুরোদমে চলছে। নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ শ্রেণির সিডিও সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রাথমিকের কাজও শুরু হওয়ার পথে। আমরা এ বছর মুদ্রাকরদের সময় কমিয়ে দিয়েছি। যারা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের কাজ করছেন তারা অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইয়ের কাজ করছেন না। ফলে দ্রুত কাজ শেষ হয়ে যাবে। আর বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে আমরা বিদ্যুৎ সচিবকে চিঠি দিয়েছি। সব বাধা কাটিয়ে আমরা এ বছরও জানুয়ারির ১ তারিখেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারব।
মুদ্রণকারীরা জানিয়েছেন, ঢাকার প্রেসগুলোর বেশির ভাগই মাতুয়াইলে। এখানে দিনের প্রায় ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। প্রতি এক থেকে দুই ঘণ্টা পরপরই বিদ্যুৎ চলে যায়। ফলে তেমনভাবে কাজই করা যাচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার প্রায় ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরে ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।