শিক্ষার্থীদের শান্ত হতে দিচ্ছে না কারা

Image

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টানাহেঁচড়া। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কারা নিয়ন্ত্রণ করছে। যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ‘কোটা নয় মেধা মেধা’ বলে রাজপথে নেমেছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ মানছেন না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে রায় না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেটাও শোনেনি। তারা শাটডাউন ঘোষণা করেছেন। এর আগে শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজাকার বলে শ্লোগান দিলেন। এসব কিসের জন্য?

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, শাটডাউন হোক রাজাকার, আল-শামস, আলবদরদের নামের তালিকা এবং সন্তান ও নাতি-নাতনিদের চিহ্নিত করার দাবিতে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধারা যা করতে করতে পারেনি, তা আপনারাই করতে পারেন।
এই দেশে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, তরুণ সমাজকে ভুল বোঝানো হচ্ছে, এর দায় আমাদেরকেই নিতে হবে। দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ কোটা সংস্কার নিয়ে কথা বলছেন, তাদের এ কথা বলছেন না দেশে আইন আছে, সরকার আছে। আমরা আইন মেনে চলি। কেউ কেউ চলমান আন্দোলনে রাজাকার শব্দকে আয়রনিক শক্তি বলেছেন।

অথচ মুক্তিযুদ্ধের বাঙালির শ্লোগান জয় বাংলা। জাতির আলোকিত মেধাবী সন্তানরা কি স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করতে চান? সন্ত্রাসী-জঙ্গি হামলার মাধ্যমে জঙ্গিরা বাংলাদেশ ও এর বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেনো তাদির কাঁধে ভর করে রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংসের সুযোগ দিলো?

চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে আন্দোলন-সমর্থক শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে প্রতিবাদ জানান। টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়ে শিক্ষার্থীরা শ্লোগান দেন-‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সংবাদ সম্মেলনে কোথাও তো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি বারের জন্যও রাজাকার বলেননি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নিজেদের কেনো রাজাকার হিসেবে মেলে ধরলেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কি প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য শুনেছেন?

সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গত ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিসিএসের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যারা উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করছেন, খুঁজে বের করা গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২৪তম বিসিএস পরীক্ষা হয়েছিলো ২০০২ বা ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে। বিএনপি আমলে যতো পরীক্ষা হতো আর যতো চাকরি হতো, এটা কোনো পরীক্ষা না। হাওয়া ভবন থেকে তালিকা পাঠানো হতো।’

সেদিন প্রধানমন্ত্রী কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে বলেছিলেন, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বিরক্ত হয়ে কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো কোটা বাদ দিলে কী হয়, তা দেখা। কোটা পদ্ধতি বাতিল করার পর বিসিএসে নারীরা পিছিয়ে পড়েছেন। সর্বশেষ বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে দুজন এবং পুলিশে চারজন নারী নিয়োগ পেয়েছেন। কোটা বন্ধ করার পর ২৩ জেলার একটি লোকও পুলিশে চাকরি পায়নি।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এতো ক্ষোভ কেনো? এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আপনারা মেধাবী, মেধার জন্য লড়াই করছেন। রাজাকার হওয়ার জন্য লড়াই করছেন না। এই শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কেউ মন্ত্রী, সাংসদ সদস্য, কেউ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কেউ বিচারক, কেউ পুলিশ কর্মকর্তা, কেউ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবেন। দেশটা তো তখন আপনাদেরকে চালাতে হবে। আইন আপনাদের মধ্য থেকে কেউ একজন প্রয়োগ করবেন। বিচার আপনাদের কেউ করবে। সেই আপনি দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের আদেশ মানছেন না! আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত হওয়া বা চূড়ান্ত রায়ের আগেই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হলো।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের মতো রাষ্ট্রের কাছে নির্বাহী আদেশের দাবি করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের একটি অঙ্গের সঙ্গে আরেকটি মুখোমুখি করার উদ্দেশ্য কোটা আন্দোলন বলে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। রাতারাতি শিক্ষার্থীদের কারাইবা রাজাকার বানিয়ে দিলেন-এসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। কোটা সংস্কার হোক আমিও চাই, তবে তা আইন-আদালতকে উপেক্ষা করে নয়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের কোটা আন্দোলন আর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের আন্দোলন এক নয়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত আসেনি। সরকারের নির্বাহী আদেশে কোটা বাতিল এসেছিলো।

আদালতে শুনানি চলমান থাকা অবস্থায় আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবি জানান। শুরুতে মিছিল, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি দিলেও এরপর শুরু হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন।

এতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক। গত ১৪ জুলাই থেকে আন্দোলনের দিকপথ পরিবর্তন হতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যে হারে টানাহঁ্যাচড়া করা হচ্ছিলো, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে নিজেকে খুবই অসহায় লাগছিলো। তবে কি মুক্তিযুদ্ধ করাটা তাদের ভুল ছিলো? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, সেই ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট, তার জন্য মানুষ কাঁদতে পর্যন্ত পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে কবর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপথগামী সেনাসদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশকে কবর দিয়েছিলেন। কিন্ত বিদেশে থাকা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধা পরিবারকে সম্মাননা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে মুক্তিযোদ্ধা লিষ্টে অনেক নামধারী মুক্তিযোদ্ধা জায়গা করে নিয়েছেন। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়া, যুদ্ধ পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি অনেক মুক্তিযোদ্ধা। সনদ না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা হয়েও দুঃসহ জীবন বয়ে চলেছেন। যারা কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করছেন, মুক্তিযোদ্ধার নিয়ে কটাক্ষ করছেন। মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সম্মান জানাতে আন্দোলন করে দেখাতে পারেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দেশটাকে ভালবাসেন। কোটা নয়, প্রাপ্য সম্মানটুকু তাদের প্রত্যাশা।

মু্ক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনকে একদল লোক শাহবাগে যুদ্ধারাপরাধী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে তুলনা করছেন। সেই আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্র আপিল করতে বাধ্য হয়েছিলো। কোটা নিয়ে করা রিট আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে। মেধার দাবি আদায় করতে গিয়ে আদালতকে অবমানা করতেও দ্বিধা করছেন না। অনেক আগে থেকেই কোটার ভেতর বিষধর সাপ ঢুকে পড়েছে। এই সাপ এখনো তাদেরকে রাজপথে নামার উস্কানি দিয়ে চলেছে। দাবি আদায় হওয়ার পরও শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরতে দিচ্ছে না কারা।
লেখক: আইনজীবী ও সাংবাদিক

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।