ডেস্ক: ফরমাল শার্ট-প্যান্টে পুরোদস্তুর একজন স্মার্ট যুবক। শিক্ষার্থীদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। তবে এই ভদ্রলোকটিকে প্রতিদিন স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ফিরে যেতে হয় কারাগারে। ভেবেছেন ছোটখাটো অপরাধের অপরাধী? না, খুনের দায়ে কারাবন্দী তিনি।
সিমলার শহিদ ভগৎ সিং মেমোরিয়াল স্কুলের এই শিক্ষকের নাম গৌরব বর্মা। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী গৌরব ভর্তি হয়েছিলেন ভারতীয়দের স্বপ্নের ক্যাম্পাস আইআইটিতেও। ওখানকার তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই ঘুরে যায় তার জীবনের মোড়।
২০১০ সালের ঘটনা। প্রেমিকা প্রগতি তিবরেওয়ালকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যান সিমলায়। আর সেখানে হোটেলে প্রবল ঝগড়াঝাটির পর বিয়ারের বোতল দিয়ে আঘাত করে খুন করেন প্রগতিকে। পরদিন সকালে হোটেল থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আর গৌরব পালিয়ে যান হরিয়ানায়।
নৃশংস এই খুনের ঘটনা তোলপাড় করেছিল গোটা ভারতেই। ধরা পড়েন গৌরব। নিজের অপরাধ কবুল করেন। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তার ঠিকানা হয় সিমলার কান্ডা মডেল সেন্ট্রাল জেল। সেটা বছর চারেক আগের কথা। হতাশায়, অপরাধবোধে ভেঙেচুরে ডুবে আছেন তখন। জীবনের কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না। তিলে তিলে জেলে পচে মরতে হবে সারা জীবন, এটাই যখন ভবিতব্য বলে ধরে নিয়ে সিমলার জেলে এলেন। এখানকার কিছুটা অন্য রকম পরিবেশ গৌরবের মনে এর মধ্যেই জীবন খোঁজার তাগিদ এনে দিল কিছুটা। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে অন্য কয়েদিদের পড়াতে শুরু করে দেন।
২০১৫ সালে সিমলার ওই জেলেই বদলি হয়ে আসেন ডিজি সোমেশ গয়াল। সব কয়েদিদের রেকর্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখ আটকে যায় গৌরবের রেকর্ডে গিয়ে। এভাবে একজন মেধাবী ছাত্র জেলে পচে মরবে! এই ভেবেই গৌরবকে ডেকে আরও ভাল ভাবে তার মেধার সদ্ব্যবহার করার পরামর্শ দেন গয়াল। কয়েদিদের পড়ানোর পাশাপাশি তাদের কম্পিউটার শেখানো, এমনকী কয়েদিদের তৈরি জিনিস অনলাইনে বিক্রির জন্য তার মেধাকে কাজে লাগান কারা কর্মকর্তা।
এভাবেই আরও একটা সুযোগ এসে গেল গৌরবের কারাজীবনে। ভারতের প্রজাতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত বছর তেমনই অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিল সিমলার শহিদ ভগৎ সিং মেমোরিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থীরা। স্কুল কর্তৃপক্ষও ছিলেন সেখানে। জেলে এমন একজন মেধাবী ছাত্র আছে; এ কথা চলে যায় স্কুল কর্তৃপক্ষের কানেও। তারাই কারা কর্মকর্তার কাছে গৌরবের খোঁজখবর নিয়ে স্কুলে শিক্ষকতার প্রস্তাব দেন।
প্রসঙ্গত, হিমাচল প্রদেশের এই ‘উন্মুক্ত কারাগার’ নীতিতে প্রায় ২ হাজার বন্দী এরকম সুবিধা পাচ্ছেন। তারা চাইলে বাইরে যেতে পারেন। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তাদের ফিরে আসতে হয়।
কিন্তু যার পরিচয় একজন খুনি, তাকে কি শিক্ষক হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হবে শিক্ষার্থী কিংবা তাদের অভিভাবকরা? এ ব্যাপারে অবশ্য খুব একটা বেগ পেতে হয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষকে। শিক্ষার্থী থেকে অভিভাবক সবাই গৌরবকে মেনে নেন।
এবছরই ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পাকাপাকি ভাবে স্কুলের শিক্ষকতার পদে যোগ দেন গৌরব। আর এখান থেকেই তার নতুন জীবনের পথ চলা শুরু। স্কুলে পদার্থবিদ্যা ও গণিত পড়ান গৌরব। জীবনের অংকে বড় ভুল করে ফেললেও, নতুন জীবনের পাঠটা কিন্তু নতুন উৎসাহের সঙ্গেই করে চলেছেন। আর সেই সুবাদে হয়ে উঠেছেন সকলের প্রিয় শিক্ষক।
গৌরবের কথায়, ‘ঘটনাচক্রে আমি একজন শিক্ষক হয়েছি। কিন্তু এই শিক্ষকতাই আমার প্রায়শ্চিত্ত। নিজে পারিনি। কিন্তু বাকি ছেলেমেয়েদের আইআইটি-র জন্য তৈরি করব।’