মো: সিদ্দিকুর রহমান:
কুকুর দিয়ে এমন কামড়
দিল শিক্ষকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তায়
বিষের জ্বালায় ভোটার তালিকা করা দায়।
ঘটনাটি ঘটেছিল খোদ রাজধানীর খিলগাঁও ৫৬০ সি চৌরাস্তার চারতলা একটি বাড়িতে।
জানা যায়, মালিক রোকসানা খানমের বাসগৃহে একত্রে বসবাস করতো একটি কুকুর। স্বাধীন দেশের নাগরিকের মতো কুকুরটিকে বেঁধে রাখতোনা। ভোটার তালিকা হালনাগাদে নিয়োজিত মানুষ গড়ার কারিগর তাহমিনা খাতুন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিদ্যালয় ছুটির পর ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজে তিনি উক্ত বাসায় যান। তাহমিনা যথারীতি চার তলায় দরজায় টোকা দেন। দরজায় টোকা দেয়ার পর একটি মেয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলার সাথে সাথে মেয়েটির পাশ দিয়ে কুকুরটি তাঁকে আক্রমণ করে। প্রথমে দাঁত বসিয়ে তাহমিনার পায়ে কামড় দেয়। কুকুরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাত দিয়ে ছাড়াতে গেলে হাতেও কামড় দেয়। এরপর কুকুরটি তাঁর মুখমন্ডল ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে।
তাহমিনা খাতুনের চিৎকারে ও কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনেও তাৎক্ষণিকভাবে ঐ বাসার কেউ এগিয়ে আসেনি। কিছুক্ষণ পর বাড়ির মালিক এসেই বলল, আপনি অনুমতি না নিয়েই বাড়িতে প্রবেশ করছেন কেন? কান্নাজড়িত কন্ঠে রক্তাক্ত অবস্থায় তাহমিনা খাতুন বললেন, দরজায় শব্দ করার পর একটি মেয়ে দরজা খুলে দেয়। শিক্ষকের সারা শরীর রক্তাক্ত ভয়াবহ অবস্থায় বাসার মালিকের ছেলে এসে বলে, এ কিছু না। পাঁচটা ইনজেকশান দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর বলে, আপনি কি মূর্খ? কাঁদছেন কেন? তাহমিনা খাতুন বললেন, আমি একজন মাস্টার্স পাস শিক্ষক। ব্যথার যন্ত্রণায় কাঁদছি। এরকম ভয়াবহ অবস্থায় আর কোন দিন পড়তে হয়নি। বাড়িতে কুকুর ছাড়া অবস্থায় কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে একটি মেয়ে বলল, আমাদের বাসার কুকুর কীভাবে রাখবো সেটা আমাদের ব্যাপার। বাসার সামনে কুকুর থেকে সাবধান বিষয়টি লিখে রাখা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তাহমিনা খাতুন। ফোন পেয়ে তাঁর স্বামী অনেকক্ষণ পর তাকে খিদমাহ্ হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। শিক্ষককে তাৎক্ষণিকভাবে হাস
পাতালে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতার পরিবর্তে বাড়ির মালিক বা তার পরিবারের সদস্যরা দাম্ভিকতা দেখিয়ে বক্তব্য রেখেছেন।
কুকুরটি উক্ত বাড়িতে জিবু আক্তার নামে এক গৃহ শিক্ষককে কামড়িয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পরের দিন তাঁকে মহাখালীর আইডিডিআরবি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি না করে স্বল্পসংখ্যক ভোটারের জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলারের কার্যালয়ে বা কোন স্কুলে কেন্দ্র করে নতুন ভোটার অন্তর্ভূক্তির কাজ করা যেত। সবুজবাগ থানাধীন রাজারবাগ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক যথাক্রমে জেসমিন
সুলতানা ও রীনা আক্তার বিদ্যালয়ের পেছনের বাড়িতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে গিয়ে কুকুরের আক্রমণ থেকে দৌড়ে রক্ষা পায়। স্বাধীন দেশে সভ্য সমাজে কোন কোন বাড়িতে দরজা খুলে শিক্ষক পরিচয়ের পর বসতে দেওয়ার মানিসকতা জাগ্রত হয় না। সরকারের উচ্চ মহলের নিষ্ঠুর করুণায় প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যাপক কর্মকা-। বেসরকারি, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ ও সরকারি অন্যান্য পেশাজীবীর কারো ওপর এর কোনো বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই। মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দয় ভালবাসা যেন উপচে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর।
সে উপচে পড়া ভালবাসার কর্মকান্ডগুলো আলোকপাত করছি:
পাঠদান বহির্ভূত কাজ: ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও হালফিল করা, ভোট গ্রহণ শিশু জরিপ, কৃষি শুমারি, আদমশুমারি, উপবৃত্তি তালিকা প্রণয়ন ও প্রাপ্তিতে সহযোগিতা, খোলাবাজারে চাউল বিক্রি তদারকি, বিস্কুট খাওয়ানো ও হিসাব সংরক্ষণ, কাঁচা-পাকা ল্যাট্রিনের হিসাব তথ্য সংগ্রহ করা, কৃমির টেবলেট, ভিটামিন এ ক্যাপসুলসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল খেলা প্রতিযোগিতায় ৪ থেকে ৫ দিন মাঠে অবস্থান রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দর্শকের সারিতে বসে থাকা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ প্রাথমিকের অনুষ্ঠান ব্যাতিরেকেও দর্শকের সারি পূরণ করার কাজ শিক্ষকদের দিয়ে করানো হয়। নিয়মিত ও বকেয়া বেতন, সমাপনী পরীক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞে প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে উঠে শিক্ষক শূন্য, অফিস হয়ে ওঠে শিক্ষকদের পদচারণায় কানায় কানায় পূর্ণ। এছাড়াও অনেক কাজে প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্যবহার করা হয়।
শিক্ষাদান সম্পর্কিত কাজ: প্রত্যেক মাসে ছাত্র হাজিরা খাতায় নাম উঠানো, দৈনন্দিন উপস্থিতি-অনুপস্থিতি হিসাব সংরক্ষণ, হোম ভিজিট, উপকরণ তৈরি, দৈনিক পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি তথ্য, প্রাথমিক শিক্ষক সমপানী সার্টিফিকেট লেখা, বছরে তিনটা পরীক্ষা ছাড়া মডেল টেস্ট, সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষার নির্ভুল তথ্য পূরণসহ বিশাল কাজ শিক্ষকদের করতে হয়। এছাড়াও প্রগতিপত্রের রেকর্ড হালফিল করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে অভিভাবকদের স্বাক্ষর নিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। প্রতি মাসে সকল শিক্ষকের স্বাক্ষর সংবলিত তথ্য লিখে মাসকাবারা ফরম অফিসে দাখিল করতে হয়। ১ জানুয়ারির পূর্বে বিনামূল্যে বই সংগ্রহ করে সিল মেরে শিক্ষার্থীদের কাছে বিতরণ, মাস্টার রোল রাখা, মিলাদ মাহফিল, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছুটির দিনে জাতীয় দিবস ও বিশেষ দিবস কর্মকা- করা। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি, স্লিপ কমিটি, বিদ্যালয়ের কল্যাণ সমিতি, শিক্ষক অভিভাবক সমিতিসহ ১১ ধরনের কমিটির সভা আহ্বান ও যাবতীয় আনুসঙ্গিক কাজ করা, বিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষাসহ সমাপনী, মডেল টেস্ট পরীক্ষার খাতা দেখে রাত্র জেগে স্বল্প সময়ে ফলাফল দেওয়া, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠকসহ অসংখ্য ফাইল হালফিল রাখতে হয়। অফিসে তথ্য পাঠানো কাজে শিক্ষকদের এক পায়ের ওপর দাড়িয়ে কাজ করতে হয়। নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় অনেক সময় পারিবারিক অনুষ্ঠান ও বহু বাৎসরিক ছুটি তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়। রাজারবাগ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনিতা সাহা জানান, ‘স্যার, পুরো রমজানের ছুটিটা আমি বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের তদারকি করে কাটিয়েছি, শিক্ষকদের শিক্ষাদান ছাড়া নানা কাজে ব্যস্ত রাখলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। এ অবস্থার
নিরসনে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি:
১. বিদ্যলয়কে শিক্ষক সংকটমুক্ত রাখতে হবে।
২. এক বা একাধিক অফিস সহকারি, অফিস সহযোগী, নাইটগার্ড, পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দিতে হবে।
৩. জাতীয় দিবসসহ বিশেষ দিবস কর্মদিন দেখায়ে ৭৫ দিনের ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা।
৪. নির্বাচন সংক্রান্ত কাজসহ সরকারি অন্যান্য কাজ সম্পাদনের জন্য ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে নির্ধারিত অফিস স্থাপন করে কর্মচারির মাধ্যমে কাজ করানো। কোন অবস্থায় শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কাজ করতে দেওয়া সমীচীন নয়।
৫. মাসকাবারা ফরমে স্বাক্ষর ও তথ্য বাতিল করে প্রধান শিক্ষকদের আয়ন-ব্যয়নের ক্ষমতা দিয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মাসিক বেতনসহ নানা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে পাওনার জন্য শিক্ষকদের অফিসমুখী না হতে হয়। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করতে হবে।
৬. পাবলিক পরীক্ষার মত সমাপনী পরক্ষার সকল কর্মযজ্ঞ বোর্ডের আওতায় আনা প্রয়োজন।
৭. বিদ্যালয়ের ১১ ধরনের কমিটি বাতিল করে প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে দাতা, অভিভাবক সদস্য ও সকল শিক্ষককে নিয়ে কার্যকর বিদ্যালয় কল্যাণ সমিতি গঠন করা।
৮. পরিদর্শককে বিদ্যালয় পরিদর্শন কালীন সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপস্থিতিতে আদর্শ পাঠ বাধ্যতামূলকভাবে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। আদর্শ পাঠ অনুসরণ করা হয় কিনা তা পরবর্তী পরিদর্শনে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
বিদ্যালয়ের বাহিরের সকল কাজের চাপ কমায়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা মানহীন হওয়া থেকে রক্ষা আজকের দিনে অতীব জরুরী। শিক্ষকদের প্রতি মর্যাদাবোধ সকলের মাঝে জাগ্রত হোক এ প্রত্যাশা।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।