রাজশাহীর লাখো শিক্ষার্থী উধাও

রাজশাহী বিভাগের আট জেলার কয়েক লাখ শিক্ষার্থী উধাও। যদিও শিক্ষা খাতের উন্নয়নে সরকার নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে তবুও থামানো যাচ্ছে না শিশুদের ঝরে পড়া। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রমাণ মিলছে সবগুলো পাবলিক পরীক্ষাতেই।

সর্বশেষ তিনটি জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছায়নি ২ লাখ ২২ হাজার ৯শ ৬০ শিক্ষার্থী। এরা সবাই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। এছাড়া গত ছয় বছরে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুনোর আগেই নেই ৭৬ হাজার ৯৭৯ শিক্ষার্থী।

সর্বশেষ পাঁচ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার আগেই ঝরেছে জেএসসি উত্তীর্ণ ৭৮ হাজার ৭২১ শিক্ষার্থী। এসএসসি উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪০ জন পৌঁছায়নি গত দুটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এইচএমসি) অব্দি।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, এদের কেউ কেউ ঝুঁকেছে কারিগরি শিক্ষায়। আবার কেউ কেউ ঝরেও পড়েছে। ঝরে পড়া রোধে বিনামূল্যে বই বিতরণ চলছে। দেয়া হচ্ছে উপবৃত্তি। বাল্যবিয়েতে নিরুৎসাহিত করা ছাড়াও রয়েছে নানান সচেতনতামূলক কার্যক্রম।

এছাড়া ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিতের অতিরিক্ত ক্লাসও নেয়া হচ্ছে। তারপরও প্রতি বছর দীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়াদের মিছিল। আর এ জন্য অর্থনৈতিক সমস্যা, শিক্ষা বৈষম্য এবং সামাজিক অবক্ষয়কে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে নিবন্ধন করে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৮২৮ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি ১৪ হাজার ২৮ জন। ৯৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ হারে সেবছর পাশ করেছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৭৯ জন।

এই ব্যাচটি থেকে তিন বছরে ঝরে যায় ৬৭ হাজার ৭৬৬ জন। এরাই ২০১৪ সালের জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ২ লাখ ৫১৩ জন। ৯৫ দশমিক ৩২ শতাংশ হারে এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয় ১ লাখ ৯১ হাজার ১৩০জন। জেএসসি উত্তীর্ণদের এ ব্যাচটির এক লাখ ৬৭ হাজার ৩৩২ জন এবারের এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তার আগেই হদিশ নেই ২৩ হাজার ৭৯৮ শিক্ষার্থীর।

রাজশাহী বিভাগের প্রাথমিক শিক্ষা দফতরের হিসেবে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় নিবন্ধিত শিক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ৫৪ জন। এর মধ্যে পরীক্ষায় বসেনি ৭৬ হাজার ৯৭৯ জন। এ ছয় বছরে পাশ করেছে ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৯ জন। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুনো এরা সবাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গেছে বলে ধরে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা দফতর।

তবে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের জেএসসি পরীক্ষা শাখার হিসেব বলছে অন্য কথা। সর্বশেষ তিনটি জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ৬ লাখ ৫১ হাজার ১৫৯ জন। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ২ লাখ ৫১৩জন, ২০১৫ সালে ২ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জন এবং ২০১৬ সালে ২ লাখ ২৬ হাজার ৮৯২ জন।

২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রাথমিক সমাপনী উত্তীর্ণ ৮ লাখ ৭৪ হাজার ১১৯ জনের ভেতর থেকে উঠে আসে এরা। এ তিন বছরে হদিস নেই ২ লাখ ২২ হাজার ৯৬০ জনের। তবে এদের একটি বড় অংশ কারিগরি শিক্ষায় গেছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষার্থী ঝরেছে মাধ্যমিকেও। ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৬৫৯ জন। এরা পর্যায়ক্রমে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সংখ্যায় এরা ৬ লাখ ৮৩ হাজার ৯৩৮ জন। পথে ঝরে পড়েছে ৭৮ হাজার ৭২১ জন। গত ২ ফেব্রুয়ারি শুরু এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনেই নেই ৪৩১ জন। এর আগের চার বছরে নিবন্ধন করেও পরীক্ষায় বসেনি ৩ হাজার ৩১২ জন।

সর্বশেষ ২০১৫ ও ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৬৬২ জন। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে এসএসসি উত্তীর্ণ ২ লাখ ২৫ হাজার ৭০২ জনের ভেতর থেকে উঠে আসে এরা। এ দুই ব্যাচ থেকে ঝরে পড়েছে ৫ হাজার ৪০ জন শিক্ষার্থী।

এরা আসলেই ঝরে পড়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজশাহীর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) বিদ্যালয় পরিদর্শক লুৎফর রহমান।

তিনি বলেন, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা পাশের পর শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ কারিগরি শিক্ষায় যায়। এছাড়া কেউ কেউ প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হচ্ছে। তবে এ সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান নেই তাদের কাছে। পরিসংখ্যান নেই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদেরও।

লুৎফর রহমান স্বীকার করেন, সরকারের নানা উদ্যোগের পরও কিছু শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। ঝরে পড়ার হার প্রত্যাশিত নয়। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষার্থীরা জেএসসি পাসের পর অর্থনৈতিক সমস্যায় ঝরে পড়ছে। মেয়েদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে ঝরে পড়া বন্ধ হচ্ছে না।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক তরুণ কুমার সরকার বলেন, ফলাফল ভালো করার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়কে বোর্ডের পক্ষ থেকে নিয়মিত চাপ দেয়া হচ্ছে। বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। শিক্ষার্থীদের পড়া লেখায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। আর এসব কারণেই দিন দিন ঝরে পড়া কমছে।

জানতে চাইলে রাজশাহীর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের বিভাগীয় পরিচালক আবুল খায়ের বলেন, দারিদ্র্য এবং বাল্যবিয়ের কারণে প্রধানত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলে ঝরে পড়ার হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। আগের বছরগুলোর তুলনায় তা অনেক কম। কয়েক বছর ধরে ঝরে পড়ার হার কমতির দিকে।

ঝরে পড়া রোধে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শতভাগ উপবৃত্তি এবং মিড ডে মিল চালু হয়েছে। দুস্থ্য ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সামগ্রীও দেয়া হচ্ছে। অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। সর্বোপরি সচেতনতায় নানান কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সমস্যায় বড় অংকের শিক্ষার্থী বিভিন্ন পর্যায়ে ঝরে পড়ছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খালেদউজ্জামান।

তিনি বলেন, লেখাপড়ার সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। লেখাপড়া দিয়ে বেকারত্ব দূর হবে এমনটির নিশ্চয়তাও নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে ঝরে পড়া।

তিনি যোগ করেন, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ঝরেপড়া শুরু। অনগ্রসর সমাজ ব্যবস্থা এটির প্রধান কারণ। অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারগুলোয় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দিকে আগ্রহ কম। এটি বন্ধে সামাজিক সচেতনতা প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শুরু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক সেমিনার সিম্পোজিয়াম হলেও মাধ্যমিক বা প্রাথমিক পর্যায়ে নেই।

তিনি আরো বলেন, সরকার খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা এমনকি উপবৃত্তির পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে বিষয়টি পৌঁছাচ্ছে না সেভাবে। এতে স্থানীয় প্রশাসনের সহোযোগিতাও নেই। ফলে সরকারের গণমুখি কর্মকাণ্ড শতভাগ কাজে আসছে না। তবে মানুষ নানান কারণে দিন দিন সচেতন হচ্ছে বলেও জানান এ গবেষক।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।