ঢাকা : ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যে স্থানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন রফিকউদ্দিন, সেখানেই ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে সেখানে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার। ২৩শে ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত; শ্রান্তি নিরসনের। প্রথম শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উঁচু আর ছয় ফুট চওড়া।
২৪শে ফেব্রুয়ারি সকালে প্রথমে শহীদ শফিউরের পিতা শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। এরপর ২৬শে ফেব্রুয়ারি সকালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক ও আইনসভার সদস্য আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। আর সেদিন থেকেই সেটা বাঙালির একটা তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়।
কিন্তু ২৭ তারিখে পাকিস্তান আর্মি বুলডোজার নিয়ে এসে পুরো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি গুড়িয়ে দেয়। এরপর সব সিমেন্ট বালি ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। তখন যে জায়গায় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করা হয়েছিল, সেই জায়গাটি ছাত্ররা কালো কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখে। তখন ওইটি হয়ে যায় প্রতীকী শহীদ মিনার।
পরের কয়েক বছর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বলতে ছিল সেই কালো কাপড়ে ঘেরা জায়গাটি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও ছুটি ঘোষণা করা হয়। সেই সময় সরকারিভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।
১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মাওলানা ভাসানী এবং শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম দ্বিতীয়বার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
কোন কোন ইতিহাসবিদ লিখেছেন, ওইদিন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ২২শে ফেব্রুয়ারি শহীদ রিকশাচালক আবদুল আওয়ালের ছয় বছরের মেয়ে বসিরণ।
শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর থেকে শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। তাকে সহযোগিতা করেন নভেরা আহমেদ। সেই নকশার মূল বিষয়টি ছিল যে মাঝখানে মা, তার চারদিকে চারটি সন্তান, যে সন্তানরা মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। মায়ের মাথাটি একটু নোয়ানো, যেন সন্তানদের দোয়া করছেন।
কিন্তু ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী আবার শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। সেই সময় কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে শহীদ মিনারের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সেই শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। তখন থেকেই এই শহীদ মিনার একুশের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই শহীদ মিনার ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। শহীদ মিনারের পাশেই নভেরা আহমেদের তৈরি করা ম্যুরাল ছিল, যেখানে ভাষা আন্দোলন ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।
এরপর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে, তখন তারা এই শহীদ মিনারটিও ধ্বংস করে দেয়। সেই ম্যুরালগুলোও তখন ধ্বংস করে ফেলা হয়। সেখানে তারা তখন ‘মসজিদ’ লিখে দেয়।
১৯৭৩ সালে আবার শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেখানে পুরনো নকশার অনেক কিছুই আর যোগ করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে শহীদ মিনারের চত্বর বিস্তৃত করে বর্তমান অবস্থায় আনা হয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা